ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে স্পষ্ট হচ্ছে নতুন মেরুকরণ ও জোট রাজনীতির নতুন সমীকরণ। আওয়ামী লীগ (Awami League) এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকায় তারা নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত, ফলে রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে একটি শূন্যতা। এই সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami), এনসিপি (NCP), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (Islami Andolon Bangladesh) এবং বামধারার রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে জোট ও সমঝোতার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও, তারা এককভাবে নয় বরং বিগত যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। জামায়াত ইসলামি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তিকে কেন্দ্র করে ইসলামপন্থি দলগুলোর নিয়ে একটি ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে আকিদাগত ও মতাদর্শিক ব্যবধানের কারণে বড় ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে তাদের ঐক্য নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।
ইসলামি দলগুলোর সমন্বয় প্রচেষ্টা
বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিস একটি ইসলামপন্থি জোট গঠনের চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে। ২৫ জুন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে একক প্রার্থী নির্ধারণসহ নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণ করা হবে। ইতোমধ্যে এসব দল একাধিকবার বৈঠক করেছে এবং অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গেও ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এনসিপি ও এবি পার্টির কৌশল
এনসিপি (NCP) বর্তমানে স্বাতন্ত্র বজায় রাখার নীতিতে চললেও বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আদর্শ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির মিলের ভিত্তিতে জোটে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। এবি পার্টির সঙ্গেও এনসিপির জোট হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান
জামায়াতে ইসলামি এককভাবে নির্বাচন করতে চাইলে তাদের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় তাদের ভোটব্যাংক শক্তিশালী, সেসব আসনে যদি বিএনপি ও আওয়ামীপন্থি কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়ায়, তাহলে ভোট ভাগ হয়ে গিয়ে জামায়াতের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে।
এক ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতা জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে অন্য ইসলামি দলগুলোর কার্যত কোনো জোট হয়নি। কারণ জামায়াতের আদর্শ ও আকিদা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর চিন্তার ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যা কওমি ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর কাছ থেকে ভিন্ন।
বিএনপির সম্ভাব্য জাতীয় সরকার ভাবনা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জোট চূড়ান্ত হয়নি, তবে সব দলের সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক রয়েছে।
বিএনপির জোটে মুহাম্মাদ মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি ইসলামি দলের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই যোগসূত্রের পেছনে রয়েছে জিয়া পরিবারের সঙ্গে মামুনুল হকের পরিবারের সুসম্পর্ক এবং তার পিতার অতীতে চারদলীয় জোটে সম্পৃক্ততা।
বিশ্লেষক মতামত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে। এর মধ্যে দুটি দল একত্রে জোট গঠন করতেও পারে। আবার বিএনপির নেতৃত্বে একটি বড় জোট গঠন হওয়াটাও সম্ভাব্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, এই নির্বাচনে অন্তত চারটি জোট তৈরি হতে পারে:
1. বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোট
2. ইসলামি মতাদর্শে পৃথক জোট
3. বামধারার জোট
4. বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও পুরাতন দলের জোট
তবে শেষ মুহূর্তে নানা মেরুকরণ ও নাটকীয় জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা রাজনৈতিক বাস্তবতায় হঠাৎ পরিবর্তন আনতে পারে।
ভোট রাজনীতির বাস্তবতা
বাংলাদেশের ভোট রাজনীতিতে দেখা গেছে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ‘ধানের শীষ’ ও ‘নৌকা’ প্রতীকের মধ্যে। যেহেতু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, দোদুল্যমান ভোটারদের ভোট মূলত বিএনপির দিকেই ঝুঁকবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ইসলামি দলগুলোর ভোট ‘ফিক্সড’ হওয়ায় তাদের বাক্সে এই ধরনের ভাসমান ভোট খুব একটা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণার পরই জোট ও সমঝোতার বাস্তব চিত্র সামনে আসবে। একইসঙ্গে কিছু এলাকায় আওয়ামী ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণে ভোট বিভক্ত হতে পারে এবং তাতে নাটকীয় জয়-পরাজয়ও দেখা যেতে পারে।