দুর্নীতির শীর্ষে বিআরটিএ, পাসপোর্ট অফিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

দেশে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মুখে পড়ছেন প্রতি তিনজন নাগরিকের একজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) সদ্যপ্রকাশিত ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)’-তে উঠে এসেছে—গত এক বছরে সরকারি সেবাগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। নারী ও পুরুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে বড় পার্থক্য: পুরুষদের মধ্যে এ হার ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, নারীদের ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ।

দুর্নীতির শীর্ষে বিআরটিএ, পাসপোর্ট অফিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

বিবিএস জানায়, সর্বোচ্চ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিআরটিএ–র বিরুদ্ধে, যেখানে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় এ হার ৬১ দশমিক ৯৪, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ এবং ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিবিরোধী কাজ করে যাওয়া টিআইবি-র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রতিবেদনের হার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই জরিপ দুর্নীতির প্রকট চিত্রই তুলে ধরেছে।” তিনি আরও বলেন, টিআইবির আগের জরিপেও যেসব খাতকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হয়েছিল, বিবিএস-এর জরিপেও সেই খাতগুলোর অবস্থান শীর্ষে।

মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণেও সংকোচ

সিপিএস-এর আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে জনগণের সীমাবদ্ধতা। মাত্র ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে—পুরুষদের ৩১ দশমিক ৮৬ শতাংশের বিপরীতে নারীদের মাত্র ২৩ দশমিক ০২ শতাংশ এই স্বাধীনতা অনুভব করেন।

রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিত্র: ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। পুরুষদের এ হার ২৬ দশমিক ৫৫, নারীদের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বিচারপ্রাপ্তির হার কম, অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা বেশি

গত দুই বছরে কোনো না কোনো বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নাগরিক। কিন্তু মাত্র ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ মানুষ বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। এর মধ্যে ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতির (যেমন: কমিউনিটি নেতা, আইনজীবী) মাধ্যমে এবং মাত্র ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে (আদালত, পুলিশ ইত্যাদি) সেবা পেয়েছেন।

নিরাপত্তা বিষয়ে আত্মবিশ্বাস বেশি, তবে নারী-পুরুষে ভিন্নতা

সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় চলাফেরা করতে ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক নিজেদের নিরাপদ মনে করেন। তবে পুরুষদের (৮৯ দশমিক ৫৩) তুলনায় নারীদের (৮০ দশমিক ৬৭) নিরাপত্তাবোধ কম। শহরাঞ্চলে এ হার ৮৩ দশমিক ৭৫ এবং গ্রামীণ এলাকায় ৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।

নিজ বাড়িতে নিরাপদ বোধ করেন ৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ—নারীদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৮২ ও পুরুষদের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে মিশ্র চিত্র

গত এক বছরে ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক অন্তত একবার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। তাদের ৮২ দশমিক ৭২ শতাংশ সেবার প্রাপ্যতা এবং ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ খরচ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে সেবা মান, ব্যবহার, সময় বরাদ্দ ইত্যাদি সূচকে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে কম—যথাক্রমে ৬৫ দশমিক ০৭, ৬৩ দশমিক ১৩ ও ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।

শিক্ষা খাতে দেখা যায়, ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি শিশু সরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৯৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ নাগরিক বলেছেন, বিদ্যালয় সহজলভ্য এবং ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে। মাধ্যমিকে এ হার কিছুটা কম।

শিক্ষার মানের বিষয়ে নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৭১ দশমিক ৮৬ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা মানসম্মত বলে মনে করেন।

বৈষম্য ও হয়রানির চিত্র: পরিবার ও কর্মস্থলে বেশি

সর্বশেষ এক বছরে দেশের ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার বেশি—১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, পুরুষদের ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শহরে বৈষম্যের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি। বৈষম্যের প্রধান ক্ষেত্র—নিজের পরিবার (৪৮ দশমিক ৪৪), গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থান (৩১ দশমিক ৩০) এবং কর্মস্থল (২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ)। তবে এসব ঘটনায় মাত্র ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভুক্তভোগী প্রতিবেদন করেছেন।

সব মিলিয়ে, বিবিএস-এর এই সরকারি জরিপে দেশের নাগরিক সেবা, সুশাসন, দুর্নীতি, নিরাপত্তা ও অধিকারভিত্তিক বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর চিত্র স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, যা নীতিনির্ধারক ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *