‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’সহ তিনটি নতুন দিবস ঘোষণার মাত্র একদিনের মাথায় সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা জানাল অন্তর্বর্তী সরকার (Interim Government)। ৫ আগস্টকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’, ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ হিসেবে পালন করতে বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (Cabinet Division) থেকে জারি করা হয়েছিল পৃথক পরিপত্র। তবে ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক, বিশেষ করে ৮ আগস্টের দিনটিকে কেন্দ্র করে।
এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizen Party – NCP) নেতাদের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে সরব হয়েছেন অনেক অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। তারা প্রশ্ন তুলছেন, এই ‘নতুন দিবসগুলো’ আদৌ প্রয়োজনীয় কি না, কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার যাদের রক্তে ও প্রতিরোধে ক্ষমতায় এসেছে—তাদের আত্মত্যাগের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ এই দিবস বাছাই।
সরকারের অবস্থান
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া শুক্রবার সাংবাদিকদের জানান, ‘দিবসবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। ঘোষিত তিনটি দিবস নিয়েই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে।’ এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দিবসগুলো প্রতিবছর যথাযথভাবে পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
তবে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরদিনই তা ঘিরে দেখা দেয় রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিতর্ক।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ৫ আগস্ট। ৮ আগস্ট না। ৫ আগস্টের সাধারণ ছাত্র–জনতার এই অর্জনকে সরকারের কুক্ষিগত করার চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না।’ তিনি স্পষ্ট জানান, এই দিবস ঘোষণা মূলত আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের সংগঠক সারজিস আলম আরও এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেন, ‘৮ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা শুরু হয়নি। দ্বিতীয় স্বাধীনতা নষ্টের, ছাড় দেওয়ার এবং বিপ্লব বেহাতের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।’
তাদের মতে, সরকার যে তিনটি দিবস ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ বরং রাজনৈতিক প্রভাব ও বিভাজনের সূচনাবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন বাংলাদেশ দিবস: এক আক্ষেপের প্রতিচ্ছবি?
তবে এনসিপি নেতাদের বক্তব্য ছাপিয়ে আরও এক তীব্র ভাষা উঠে আসছে সামাজিক মাধ্যমে। একের পর এক অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট লিখছেন, “যে কারণগুলো সামনে রেখে এই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলো—সেই মূল কারণগুলোর একটিতেও আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসেনি।”
তাদের মতে, শহীদ আবু সাঈদদের রক্তের বিনিময়ে যে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, সেই স্বপ্ন পূরণে এই সরকার এখন পর্যন্ত ব্যর্থ।
একজন সামাজিক কর্মী লিখেছেন, “আজও জনগণের কাছে এসে এই সরকার কিছু জানতে চায়নি। কোনো ‘জুলাই সনদ’ আসেনি। পুলিশের জবাবদিহিতা হয়নি। আমলাদেরও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি।”
আরও কেউ লিখছেন, “নতুন বাংলাদেশ বলে কিছুই নেই এই সরকারের হাতে। বরং এই সরকারই আমাদের সেই পুরনো জায়গাতেই আটকে রেখেছে—যেখানে পুলিশি দমন, আমলাতন্ত্র আর জবাবহীনতা ছিল এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা।”
ফলত, অনেকে মনে করছেন, সরকার তিনটি নতুন দিবস ঘোষণার মাধ্যমে আসলে আন্দোলনের চেতনাকে বাণিজ্যিকীকরণ ও পৃষ্ঠপোষকীকরণ করছে—যার সঙ্গে প্রকৃত পরিবর্তনের কোনো সাযুজ্য নেই।
মূল প্রশ্ন এখন একটাই—এই তিন দিবসের ভবিষ্যত কি? সরকার আদৌ কি নাগরিকদের ক্ষোভ ও ইতিহাসের দাবি মেনে সিদ্ধান্ত পাল্টাবে? নাকি কিছু ‘আনুষ্ঠানিক রঙ’ লাগিয়েই কৌশলে এগিয়ে যাবে?