“মবের মুল্লুক” বাংলাদেশ: ১০ মাসে ৩ শতাধিক ঘটনায় নিহত ১৬৩

একটি সকাল কারো জন্য হয়তো ছিল শান্তিময়, কিন্তু কুমিল্লার এক পরিবারের জন্য তা হয়ে উঠল বিভীষিকার দিন। কড়ইবাড়ি, মুরাদনগর, কুমিল্লা-তে গত বৃহস্পতিবার মা রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৮) এবং মেয়ে জোনাকী আক্তার (৩২)-কে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় লোকজন। অভিযোগ, তাঁদের বিরুদ্ধে মোবাইল চুরির অপবাদ ছিল। রাসেল মিয়ার স্ত্রীর আর্তনাদ—“মানুষ কীভাবে মানুষকে এভাবে পেটাতে পারে”—শুধু একটি পরিবারের কান্না নয়, গোটা সমাজের বিবেকের ওপর প্রশ্ন।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান জানান, অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত আইনের মাধ্যমে, গণপিটুনি নয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের হত্যাকাণ্ডের পরও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

এটাই শেষ নয়—গাজীপুরে গ্রিনল্যান্ড লিমিটেড কারখানায় চুরির অপবাদে পিটিয়ে মারা হয় ১৯ বছরের যুবক শ্রমিক হৃদয়কে। টাঙ্গাইলের হৃদয় ছিলেন একজন মেকানিক্যাল মিস্ত্রি। মামলা হলেও এর পরেই যেন সব থেমে যায়।

‘মব সন্ত্রাস’ এখন যেন নতুন দুঃস্বপ্ন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে এমন ২৫৩টি ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৩ জন, আহত হয়েছেন ৩১২ জন। বেসরকারি সংগঠন মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (MSF) তথ্য অনুযায়ী, শুধু জুন মাসেই ৪১টি ঘটনার মধ্যে মারা গেছে ১০ জন, আহত ৪৭। এমনকি ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (HRSS) -এর আলাদা প্রতিবেদনে গণপিটুনির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মূলত, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক কোন্দল, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, এবং প্রতিশোধপরায়ণতা থেকেই জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “সরকার নানা আদেশ জারি করলেও মব সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিচয়েও মব তৈরি হচ্ছে। দলের ভেতর থেকেই প্রতিকার জরুরি।” এমন অবস্থায় পুলিশ প্রধান আইজিপি বাহারুল আলম স্বীকার করেছেন, পুলিশের একার পক্ষে এই সহিংসতা ঠেকানো সম্ভব নয়, প্রয়োজন সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ।

রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে। গত মঙ্গলবার ঢাকার মুগদায় ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ যায় তরুণ আল আমিনের। লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গণপিটুনিতে আটকে রাখা হয় সেলুনকর্মী ও তাঁর ছেলেকে। উত্তরা, গুলশান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমণ্ডি—সবখানেই বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মব সহিংসতা।

এমনকি সাবেক নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা-কেও গণপিটুনির মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এরকম ঘটনা কাম্য নয়।

বিএনপি এই সহিংসতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। অপরাধীর বিচার রাস্তায় নয়, আদালতে হবে।” একইসঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোট সরকারের ‘নীরবতা’ এবং ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ। তাঁদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পটিয়া, মুরাদনগর, ফরিদপুর, লালমনিরহাট—সর্বত্রই এই সহিংসতা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, “নতুন আপদের নাম মব সন্ত্রাস। এটি বন্ধ না হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।” সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন-এর উপদেষ্টা মুজিব রহমানের আহ্বান, “মানুষকে ন্যায়ের আশ্বাস দিতে হবে, মব নয়।”

চট্টগ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত মব ঢুকে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকে ধরতে। প্রশ্ন উঠছে—রাজনৈতিক ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এই মব দানবকে আদৌ থামানো সম্ভব?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *