সরাসরি গুলির নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা, ফাঁস হওয়া অডিওর সত্যতা নিশ্চিত করল বিবিসি

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন—এমন এক বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি আই (BBC Eye) তাদের “এক্স-বাংলাদেশ লিডার অথরাইজড ডেডলি ক্র্যাকডাউন, লিকড অডিও সাজেস্ট” শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অডিওর সত্যতা নিশ্চিত করেছে এবং জানিয়েছে যে এটি সম্পাদিত নয়, কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়নি, এবং সত্যিকার অর্থেই শেখ হাসিনার কণ্ঠ।

অডিওটিতে হাসিনাকে একজন অজ্ঞাত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে শোনা যায়: “যেখানেই ওদের পাবে, গুলি করবে।” এই কলটি রেকর্ড করেছিল বাংলাদেশের জাতীয় যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (NTMC), যা ২০২৫ সালের মার্চে অনলাইনে ফাঁস হয়। অডিওর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করেছে ‘ইয়ারশট’ নামক একটি আন্তর্জাতিক অডিও বিশ্লেষণ সংস্থা। তারা অডিওর পটভূমির শব্দ, বিদ্যুৎ ফ্রিকোয়েন্সি ও কণ্ঠের ছন্দ বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে—এটি সম্পূর্ণ আসল ও অখণ্ড।

এই রেকর্ডটি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। উল্লেখ্য, হাসিনার অনুপস্থিতিতেই এই বিচার শুরু হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, বেসামরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা পরিচালনা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে।

২০২৪ সালে শুরু হওয়া ওই গণআন্দোলনের সূত্রপাত হয় সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে। একপর্যায়ে আন্দোলন তীব্র গণবিক্ষোভে রূপ নেয়, যা হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। জাতিসংঘের হিসেবে, এই আন্দোলনে অন্তত ১,৪০০ মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল ৫ আগস্ট, যেদিন হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান এবং গণভবন ঘিরে ফেলে জনতা।

আওয়ামী লীগ (Awami League) অবশ্য অডিওটির সত্যতা অস্বীকার করেছে। দলটির একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, “আমরা নিশ্চিত নই যে এটি আসল কি না।” তিনি আরও দাবি করেন, অডিওতে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কোনো বেআইনি উদ্দেশ্য’ প্রতিফলিত হয় না।

বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যাত্রাবাড়ী এলাকায় ৫ আগস্ট সংঘটিত এক ঘটনায় পুলিশ কমপক্ষে ৫২ জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করে। এই তথ্য প্রথমে গোপন ছিল, তবে সিসিটিভি, ড্রোন ও মোবাইল ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক হস্তক্ষেপের পর পুলিশের ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু হয়, যা চলে প্রায় ৩০ মিনিট। পালিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের গলিপথ ও মহাসড়ক ধরে পেছনে ছুটে গুলি করে পুলিশ।

এই সহিংসতার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়, যাতে ছয় পুলিশ সদস্য নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে।

এই সহিংসতার পটভূমিতে বিবিসির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—হাসিনার নির্দেশেই সামরিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হয়। ‘ফাঁস হওয়া অডিও এবং পুলিশের নথিপত্রের মধ্যকার মিল প্রমাণ করে যে, এই সহিংসতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত এবং পরিকল্পিত।’

বর্তমানে শেখ হাসিনার বিচার চললেও ভারত তাকে এখনো বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়নি, যদিও বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে বারবার অনুরোধ জানিয়েছে। মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান (Toby Cadman) বলেন, “হাসিনা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন বলে মনে হয় না।”

এদিকে, হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)। তার নেতৃত্বাধীন সরকার এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যদিও এখনো নিশ্চিত নয়, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে কিনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *