রাজনীতিতে চরম কাদা ছোড়াছুড়ি: সেনাপ্রধানের সেই সতর্কবার্তা এখন নতুন আলোচনায়

রাজনীতিতে বাড়তে থাকা কাদা ছোড়াছুড়ি ও অশালীনতা নিয়ে এখন ফের আলোচনায় এসেছে সেনাপ্রধান (Chief of Army Staff) এর সেই পুরনো সতর্কবার্তা, যা তিনি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে রাওয়া ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে দিয়েছিলেন। তখন তিনি রাজনৈতিক বিভাজন ও সহিংসতা পরিহার করে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমরা চাই না হানাহানি, আমরা চাই সুখ-শান্তির দেশ।”

তিনি বলেছিলেন, “আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তা-চেতনার বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু দিন শেষে আমরা সবাই দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে সবাই যেন এক থাকতে পারি। কেবল এক থাকলেই এ দেশ উন্নত হবে, সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরো সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব। ওই দিকে আমরা যেতে চাই না। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন সতর্ক করিনি। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। সেই উদ্দেশ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

তার সেই কথার গুরুত্ব এখন যেন সময় নিজেই সামনে এনে দিয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে হত্যার পর উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট (BUET) সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হলেও, তার রেশ ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (Tarique Rahman) কে উদ্দেশ করে উঠেছে অশ্লীল স্লোগান, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir) অভিযোগ করেছেন, সরকারে না থেকেও একটি দলকে উদ্দেশ্য করে পরিকল্পিতভাবে কুৎসা রটানো হচ্ছে। তার ভাষায়, “এই হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে আমাদের দলের বিরুদ্ধে নোংরা রাজনীতি চলছে। এটা আবার সেই ফ্যাসিবাদের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনছে।”

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কাজী ইফতেখার-উল-আলম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক না। দেশের জন্য এখন সবচেয়ে দরকার একতা।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী (Dilara Chowdhury) মনে করেন, এ সংস্কৃতির শিকড় বহু পুরোনো—পাকিস্তান আমলে। এখন এই কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি আমাদের নতুন প্রজন্মকেই প্রভাবিত করছে। তার মতে, “রাজনীতিবিদদের চরিত্রহনন ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার একটা রাজনৈতিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।”

একই মত প্রকাশ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বির আহমেদ (Dr. Sabbir Ahmed)। তিনি বলেন, “একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর পরই যেভাবে একটি দল ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করা হলো, তা খুবই দুঃখজনক। এতে মনে হয়, হয়ত নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা চলছে।”

তিনি আরো বলেন, দেশের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন হুমকির মুখে। “আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ভুল নেতৃত্বের কারণে গ্রহণযোগ্যতা হারায় এবং বিএনপিকেও দুর্বল করে দেওয়া হয়, তাহলে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা দেশের জন্য বিপজ্জনক।”

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম (Mahfuz Alam) তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “বিরোধিতা যেন বিদ্বেষে রূপ না নেয়। বড় শয়তান এখনো আমাদের কাঁধে শ্বাস ফেলছে।” তিনি বলেন, “সবাইকে এখন হিসেব-নিকেশ করতে হবে। হঠকারীদের স্পেস দিলে দেশেরই ক্ষতি।”

এ প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) আমির শফিকুর রহমান (Shafiqur Rahman) তার বক্তব্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও শালীনতা বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “যুক্তিনির্ভর সমালোচনা হোক, চরিত্রহনন নয়। এটাই দেশের জন্য কল্যাণকর।”

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (Prof. Muhammad Yunus) এর পূর্ববর্তী উদ্যোগও এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। গত ডিসেম্বরে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা অনেক দলই তখন সমর্থন করেছিল।

সেনাপ্রধানের ঐ বক্তব্যকে এখন অনেকেই মূল্যায়ন করছেন ভবিষ্যদ্বাণীমূলক সতর্কবার্তা হিসেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি চলতে থাকলে তা গণতন্ত্র নয়, বরং পতিত স্বৈরাচারকে ডেকে আনবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই বিবেচনায় নিতে হবে—কোন পথে তারা দেশকে নিতে চায়?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *