সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের বয়ানে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় গুপ্ত শিবিরকর্মীদের ভয়াবহ নৃশংসতার বর্ণনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের গোপন তৎপরতা এবং ছাত্রলীগের ছায়ায় থেকে তাদের নিপীড়নমূলক ভূমিকার বিস্ফোরক বিবরণ দিয়েছেন আবদুল কাদের (Abdul Kader), গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। রোববার রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে কাদের অভিযোগ করেন, হলে থাকার সুযোগে একদা শিবির সংশ্লিষ্ট ছাত্ররা নিজেদের ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হয়ে উগ্রতায় জড়ান, চালিয়ে যান ভয়াবহ নিপীড়ন ও সন্ত্রাস।

তার ভাষায়, “শিবির করে আসা ছেলেরা ছাত্রলীগ প্রমাণ করার জন্য অতি উৎসাহী হয়ে উঠত—একটা আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে। তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন কোনো অংশে কম ছিল না।”

নাম নিয়ে গোপন খেলা ও আইডেনটিটি বদলের চেষ্টা

ফেসবুক পোস্টে কাদের জানান, ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার দপ্তর সম্পাদক মুসাদ্দিক বিল্লাহ ছিলেন শিবির সংশ্লিষ্ট, যদিও পরে কট্টর ছাত্রলীগার হয়ে ওঠেন। একইভাবে ৭১ হলের শাহরিয়াদের ওপর হামলার সময় নেতৃত্বে থাকা মাজেদুর রহমান ও আফজালুন নাঈমকেও তিনি সাবেক শিবির কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেন।

কাদের লিখেছেন, “নাঈম এখন শিবিরের আইকনিক নেতা শিশির মনিরের বিশেষ সহকারী। ইলিয়াস হোসাইন নামে মুজিব হলের আরেক কট্টরপন্থী, যিনি গেস্টরুমে মেন্টাল টর্চার চালাতেন, তিনিও এখন শিবির নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করেন।”

শাহাদাত, বান্না ও রায়হান—কাদের ‘গুপ্ত শিবির’ বলছেন যাদের

মুহসীন হলের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. শাহাদাত হোসেন ওরফে সোহেল সম্পর্কে কাদের বলেন, “তিনি শিবির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে ছাত্রলীগে এসে ভুক্তভোগীর মোবাইল চেক করে অতর্কিত হামলা চালান।”

জহুরুল হক হলের হাসানুল বান্না ও এ এফ রহমান হলের রায়হান উদ্দিনের নামও এসেছে, যারা ছাত্রলীগের জন্য ‘গেস্টরুম কালচার’ চালাতেন। কাদেরের দাবি, “বান্না এখন শিবিরের জহুরুল হক হল শাখার বড় নেতা। রায়হান নিজের পুরনো ফেসবুক আইডি মুছে দিলেও নিপীড়নের রেকর্ড এখনো রয়ে গেছে।”

‘সাঈদী’ নাম বদলে ‘সাঈদ’, ছাত্রলীগ পদে জয়ী, পরে আবার শিবির

বিশেষভাবে আলোচনায় আসে এক শিক্ষার্থীর নাম, যার মূল নাম ছিল হাসান সাঈদী। শিবির সংশ্লিষ্টতা এবং নামের কারণে পদ না পেয়ে হতাশ হয়ে তিনি নিজেকে উগ্র ছাত্রলীগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং শেষ পর্যন্ত নাম বদলে ‘সাঈদ’ হয়ে যান।

অভিযোগ অনুযায়ী, “সে এক সময় একাত্তর হল ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদকও হন। এমনকি জুলাইয়ের এক ঘটনায় মুহসীন হলে ব্যবসায়ী অপহরণ ও আটকে রাখার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। পরে জেল থেকে রহস্যজনকভাবে মুক্তি পান।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন কাদের। তখন শিক্ষার্থীরা তাকে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে দেখে ফেলেন এবং আটক করেন। তখনও শিবিরের তৎকালীন সভাপতি সাদিক কায়েম (Sadik Kayem) ফোন করে তদবির করেন বলে দাবি।

মামলার তালিকা বদলে দিতে শিবির নেতার তদবির

আবদুল কাদের অভিযোগ করেন, “জুলাইয়ের হামলার ঘটনায় দু’টি মামলা হয়। বাদী মাহিন সরকার ও আরমান হোসেনের সঙ্গে দেখা করে শিবির নেতা সাদিক কায়েম কয়েকজনের নাম বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দেন।”

আরমানের ভাষ্য অনুযায়ী, “যাঁদের নাম বাদ দেওয়ার তদবির করা হয়, তাঁদের মধ্যে একজন সরাসরি স্বীকার করেছেন যে তিনি শিবির করেন।”

ব্যাচ প্রতিনিধি নির্বাচনে শিবিরের ছায়া

৫ আগস্টের ঘটনার পরে হলে হলে ব্যাচ প্রতিনিধি নির্বাচনে অনলাইনে ভোটাভুটির মাধ্যমে শিবির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জয়ী করানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন কাদের। “তাঁরা পরে হলে ছায়া প্রশাসনের মতো কাজ করতেন, ছাত্রলীগের তালিকা তৈরির দায়িত্বেও ছিলেন এবং নিজেদের লোকদের বাঁচিয়ে দিতেন।”

সাদিক কায়েমের প্রতিক্রিয়া

প্রথম আলোকে দেওয়া এক মন্তব্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আবদুল কাদেরের সঙ্গে আমার এসব বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। আমি শুধু নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হচ্ছেন কিনা, তা জানতে চেয়েছিলাম।”

‘জুলাইয়ের অঙ্গীকার রক্ষা হয়নি’

ফেসবুক পোস্টের শেষদিকে আবদুল কাদের আক্ষেপ করে লেখেন, “জুলাইয়ের ঘটনায় সবাই নিজের দলের মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে শিবির-সংশ্লিষ্ট নিপীড়কদের ছেড়ে দিয়েছে। শিবির বলছে তাদের কেউ ছাত্রলীগে গিয়েই না। যদি না-ই হয়, তাহলে বিগত এক যুগের হল কমিটি ও ঢাবি কমিটি প্রকাশ করুক। তাহলেই তো ক্লিয়ার হবে, তারা কোথায় ছিল। এখন হলে হলে শিবিরের হয়ে যে মাদবরি করছে, তাদের আসল চেহারাও প্রকাশ হবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *