রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে পৌঁছালো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর খসড়া

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন নিয়ে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় ছিল, এই খসড়ায় সেগুলোকেই একত্র করে আনা হয়েছে।

খসড়ার পটভূমিতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরে তা অর্জিত হয়নি। বরং রাষ্ট্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংবিধান সংশোধন, নিবর্তনমূলক আইন, দলীয়করণ ও দুর্নীতির অভিযোগ সনদে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে জনগণের আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক ও তার অনুসারীদের পতনের পর রাষ্ট্রকাঠামো নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রবল চাহিদা তৈরি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে এই সনদে সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান সংস্কার

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’। একইসঙ্গে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য ভাষাকে প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশের নাগরিকরা ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ে পরিচিত হবে।

সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট অপরিহার্য করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে গণভোট বাধ্যতামূলক হবে। বিদ্যমান সংবিধানের ৭ক ও ৭খ ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার নিয়মেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে—এখন তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়া হবে না, আর সেই বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী

রাষ্ট্রপতি আইনসভার দুই কক্ষের গোপন ভোটে নির্বাচিত হবেন। তিনি কোনো দলের পদে থাকবেন না। প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে রাষ্ট্রপতি সরাসরি নিয়োগ দেবেন। অভিশংসন প্রক্রিয়া কঠোর করা হয়েছে, আর ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা ভুক্তভোগীর সম্মতির শর্তে প্রয়োগযোগ্য হবে।

প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ বছর। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হতে পারবেন না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

খসড়ায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য জটিল ও বহুধাপীয় একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি মিলিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন। এ সরকার সর্বোচ্চ ৯০ দিন দায়িত্ব পালন করবে, প্রয়োজনে ৩০ দিন বাড়ানো যাবে।

আইনসভা সংস্কার

বাংলাদেশে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রস্তাব করা হয়েছে—নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ, উচ্চকক্ষ সিনেট। উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য অনুপাতিক ভোটে নির্বাচিত হবেন। নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে ধাপে ধাপে ১০০ আসনে উন্নীত করার প্রস্তাব এসেছে। একইসঙ্গে দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।

বিচার বিভাগ সংস্কার

রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। বিচারক নিয়োগে স্বাধীন Judicial Appointments Commission (JAC) গঠনের প্রস্তাব এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রতিটি বিভাগে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে শক্তিশালীকরণ এবং বিচারকদের সম্পদ বিবরণ প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হবে।

নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনের কাছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও হস্তান্তর করা হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারি সেবা খাতে অটোমেশন, ব্যক্তিগত সম্পদ বিবরণ প্রকাশ এবং বেসরকারি খাতের ঘুষকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে।

কমিশনের প্রেক্ষাপট

গত বছর মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর ছয়টি সংস্কার কমিশন তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা চালিয়ে যায়।

প্রথম দফায় ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে ৪৭টি বৈঠক শেষে ১৬৬টি সুপারিশ সংগ্রহ করা হয়। পরে দ্বিতীয় দফায় আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণীত হয়। এই সনদই ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের নীলনকশা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *