অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশে অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation বা পিআর) চালুর দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। সংস্কার কমিশনের আলোচনায় বিষয়টি না থাকলেও হঠাৎ করেই রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠেছে এই দাবি নিয়ে। তবে এই দাবি শুধু নির্বাচনী সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা এক ধরনের কৌশলগত রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ বলেই অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। তাদের মতে, এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো দেশে একটি দুর্বল, জোটনির্ভর এবং সহজেই ভাঙনশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে এবং প্রতিবেশী ভারত (India)-এর মতো শক্তির প্রভাবও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট উদাহরণ। দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থায় রয়েছে মিশ্র পদ্ধতি—সরাসরি ভোট (FPTP) এবং পিআর। মূলত ভারতের পাতা ফাঁদে প্রিয় এই মিশ্র ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় দেশটিতে। এর ফলে সংসদে নানা ছোট ছোট দল যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবেই নেপালে বারবার জোটনির্ভর সরকার গড়ে উঠেছে, কিন্তু একই সঙ্গে তা দ্রুত ভেঙেও পড়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে কেবিনেট পরিবর্তনের ঘটনা সেখানে নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক অস্থিরতা এবং নীতি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা যেন এই পদ্ধতির অবশ্যম্ভাবী ফল হয়ে উঠেছে। নেপালের অভিজ্ঞতা এটাই দেখায় যে, ছোট দলগুলোর বাড়তি গুরুত্ব একটি মাত্র জোট বদলের মাধ্যমে পুরো সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও কম জটিল নয়। সাম্প্রতিক নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোও প্রত্যেকবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ভোট বিভাজন এমনভাবে হয়েছে যে ছোট দলের উপস্থিতি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি সেই সময়ে পিআর ব্যবস্থা চালু থাকত, তবে বড় দলগুলো বাধ্য হয়ে ছোট ছোট দলের সঙ্গে জোট গড়ে সরকার চালাতে হতো। আর এ ধরনের জোট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকত প্রতিনিয়ত, যার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও গভীর হতো। এতে একক ও শক্তিশালী সরকারের পরিবর্তে দুর্বল ও ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থা দেখা দিত, যা কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাই নয় বরং বিদেশি শক্তির কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগও বাড়িয়ে তুলত।
এ প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ভারত সরাসরি বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনার মতো অবস্থায় নেই। তাই তারা একটি দুর্বল, জোটনির্ভর সরকার গড়ে তা নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল খুঁজছে। নেপালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের ফলে এক ধরনের ‘influence vacuum’ তৈরি হয়, যেখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে সুযোগ নেয়। একই বাস্তবতা বাংলাদেশেও তৈরি করতেই ভারতের এমন ফাঁদ।
পিআর দাবির স্থানীয় উৎসও কম বিতর্কিত নয়। এ দাবি প্রথম সামনে আনে এমন এক রাজনৈতিক মহল, যারা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ (Awami League)-এর পাশে ছিল। মূলত ১৫ বছর ধরে আওয়ামীলীগের নির্বাচনকে বৈধতা দিয়ে যাওয়া, আওয়ামীলীগকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে যাওয়া ইসলামী আন্দোলন খোলস বদলে গণআন্দোলনের পক্ষের শক্তি বনে পরবর্তীতে নিজেদের কৌশল বদলে তারা এই দাবিকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের স্লোগানকে সামনে রেখে জামায়াত (Jamaat) ধীরে ধীরে এতে সম্পৃক্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত পিআর তাদেরও মুখ্য দাবিতে পরিণত হয়। ইতিহাস বলছে, এ ধরনের কৌশল প্রায়শই দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে, কারণ এগুলো সংখ্যালঘু শক্তি ও কুচক্রী জোটনির্ভরতায় আটকে থাকে, যা জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, যখন উপমহাদেশের কোনো দেশের নিজের পক্ষের সরকার ব্যর্থ হয়, তখন ভারতের প্রভাবশালী কৌশল হিসেবে সেখানে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা অনুপাতভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করার দিকে দৃষ্টি দেয়। এই ধরনের ব্যবস্থা সাধারণত সরকারকে স্থায়ী শক্তি গড়ে তুলতে দেয় না, ফলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। স্থিতিশীল সরকার না থাকায় পরিস্থিতি ভারতের জন্য সর্বাধিক লাভজনক হয়ে ওঠে, কারণ এভাবে তারা আস্থাভাজন নেতৃবৃন্দকে ক্ষমতায় ফেরানোর পথ তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে দেশজুড়ে পরিবর্তনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না, যা জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। সেই হতাশার মধ্যে মানুষ পূর্বের ভারতের সমর্থিত কর্তৃত্ববাদী সরকারকেই এক প্রকার স্বাভাবিক ও ‘বাঞ্ছনীয়’ হিসেবে দেখার প্রবণতা পায়।
সব মিলিয়ে পিআর ব্যবস্থা তাত্ত্বিকভাবে আকর্ষণীয় মনে হলেও বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। নেপালের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে দেয়, পিআর-ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের হার বেড়ে যায় এবং সেই ফাঁক থেকেই অভ্যন্তরীণ কিংবা বিদেশি শক্তি সুবিধা নিতে পারে। প্রশ্ন ওঠে, পিআরের মতো ইস্যুটি মাঠে আনছে জামায়াত কার ইন্ধনে? বাস্তবে, এমন ইস্যু নিয়ে জামায়াত আগে কখনো সংস্কার কমিশনের বৈঠকে আলোচনা ছাড়াই বিষয়টি হঠাৎ সামনে নিয়ে আসে। আওয়ামী লীগ ও ভারতের প্ররোচনায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টা শুরু হলে জামায়াত হঠাৎ এই ইস্যুকে নতুন আঙ্গিকে সামনে নিয়ে এসে আগুনে ঘি ঢালার ষড়যন্ত্রে নামে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: এ ইন্ধন যোগাচ্ছে আসলে কে? —এসব বিষয়ে সতর্ক তদন্ত ও ব্যাখ্যা এখন সময়ের দাবি।