আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি যখন জোরদার, তখন জুলাই জাতীয় সনদ (July National Charter) ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। সংলাপের শেষ ধাপে এসে ৩০টি রাজনৈতিক দল প্রায় একমত হলেও, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)-এর ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজ (Dr. Ali Riaz) এখনো এই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় ‘যদি-কিন্তু’ খুঁজছেন। সমালোচকদের মতে, এই ‘সময়ক্ষেপণ’ই কমিশনের মেয়াদ দীর্ঘায়নের কৌশল হতে পারে।
রোববার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের শেষ ধাপের সংলাপ। সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. আলী রীয়াজ, আর সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-এর বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সংলাপের শুরুতেই রীয়াজ বলেন, “যদি রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একমত হতে না পারে, তবে কমিশন একাধিক বাস্তবায়ন প্রস্তাব তৈরি করবে।” তাঁর মতে, দলগুলোর ছয়টি প্রস্তাবের মধ্য থেকে একটি একক রূপরেখায় একমত হলে সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করা সহজ হবে।
তবে সংলাপে উপস্থিত বিশ্লেষকদের মতে, রীয়াজের বক্তব্যে ‘একটি ক্ষুদ্র স্বার্থ’ লুকিয়ে আছে—কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়াস। কারণ, “বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া” নিয়ে নতুন দফার আলোচনার অর্থ কমিশনের কাজের সময়সীমা বাড়ানো। কিন্তু বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সুস্পষ্ট অবস্থান সেই পরিকল্পনায় ছেদ ফেলেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রথমেই ফ্লোর নিয়ে ড. আলী রীয়াজের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, “আমি হয় তাঁর কথা ঠিক বুঝিনি, নয়তো ইন্টারপ্রিটেশনটা মিসলিডেড হবে।” তাঁর মতে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে এখনই যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের জন্য গণভোট দরকার, সেগুলো পঞ্চদশ সংশোধনীর পর হাইকোর্টের রায়ে পুনর্বহাল হয়েছে। এখনকার আলোচনার প্রশ্ন হলো—জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে জনগণের অনুমোদন কীভাবে নেয়া হবে।
সালাহউদ্দিন প্রস্তাব দেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে—একই ব্যালটে জনগণ ভোট দেবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, সনদের পক্ষে বা বিপক্ষে। এর জন্য সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; বরং আরপিও (RPO)-তে সামান্য সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় প্রশ্নে গণভোটের ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে। এতে সরকারের গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে রেফারেন্ডাম আয়োজন সম্ভব হবে।
জবাবে ড. আলী রীয়াজ স্বীকার করেন যে সালাহউদ্দিন ভুল বলেননি। তিনি ব্যাখ্যা দেন, “আমরা সকলেই একমত যে রেফারেন্ডাম হবে। এখন আলোচনার বিষয়—যে বিষয়গুলো সনদে আছে, সেগুলোর কিছু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ; তাই ভবিষ্যৎ সংসদে সংবিধান সংশোধনের সময় এগুলো ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে আসবে কি না, সেটিই এখন বিবেচ্য।”
সংলাপে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, “সংবিধান মেনে শপথ নিয়েছে সরকার। সেখানে রেফারেন্ডামের কোনো সুযোগ নেই, ক্ষমতাও নেই। সংবিধান টাচ করতে হলে ১০৬ অনুচ্ছেদের পথেই আসতে হবে।” তাঁর মতে, ইলেকশন কমিশনের হাতে জাতীয় প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের এখতিয়ার নেই, তাই এটি সংবিধান সংশোধন ছাড়া সম্ভব নয়।
জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “যদি কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করে, সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়া যেতে পারে ১০৬ অনুচ্ছেদে। তখন বর্তমান সরকারের বৈধতা ও জুলাই সনদের রেটিফিকেশন একইসঙ্গে সমাধান হবে।” তাঁর এই মন্তব্যে অনেকেই সম্ভাব্য সাংবিধানিক জটিলতার দিকটি তুলে ধরেন।
এদিকে, সংলাপে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-এর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ প্রস্তাব করেন, জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট নির্বাচন তফসিলের আগেই হওয়া উচিত—“নভেম্বর বা ডিসেম্বরে গণভোট হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কোনোভাবে বিঘ্নিত হবে না,” বলেন তিনি। তাঁর মতে, “গণভোট আগে হলে জনগণ ও রাষ্ট্র উভয়েই বাঁচবে।”
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens Party)-এর যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই দিতে হবে। কারণ পরবর্তী সরকার চাইলে তা বাদ দিতে পারে।” তিনি জানান, অধিকাংশ দলই একমত যে জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের আলাদা ব্যালট থাকবে—যেখানে জনগণ সনদের আইনি স্বীকৃতির বিষয়ে মতামত জানাবে।
তুষার আরো বলেন, “ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে দলগুলো জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে মোটামুটি একমত। জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটই সনদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”
ফরেন সার্ভিস একাডেমির এই সংলাপ শেষে রাজনৈতিক মহলে এখন জোর প্রশ্ন—জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন সত্যিই কি ঐকমত্যের পথে যাচ্ছে, নাকি ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশন নতুন করে সময় ও বিতর্ক তৈরি করছে?