ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই গোপনে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী (Saber Hossain Chowdhury) এবং তিন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের রাষ্ট্রদূত।
নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন আরাল্ড গুলব্রানসেন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মলার ঢাকার গুলশান-২ এ সাবের হোসেনের ব্যক্তিগত বাসভবনে সোমবার (৬ অক্টোবর) দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে প্রবেশ করেন এবং বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপী চলে এই অতি গোপনীয় বৈঠক।
বৈঠকটি সম্পর্কে জানা গেছে, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সাবের হোসেন চৌধুরীর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চান। বিশেষ করে, নিষিদ্ধ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কীভাবে অংশ নিতে পারে, এবং দলটির সক্রিয় হবার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা —এ নিয়েই মূলত আলোচনা হয়।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে, এই বৈঠকের বিষয়ে সচেতনভাবে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। রাষ্ট্রদূতরা ফ্ল্যাগবিহীন একটি গাড়িতে করে একসঙ্গে প্রবেশ করেন এবং বৈঠক শেষে বিকল্প রুট ব্যবহার করে স্থান ত্যাগ করেন, যাতে সাধারণ নজর এড়ানো যায়। এমন বৈঠকে সাধারণত যে কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা থাকে, সেটিও এখানে অনুপস্থিত ছিল।
নর্ডিক রাষ্ট্রগুলো—বিশেষত নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক—দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। এই বৈঠকে অংশ নেওয়া তিন দেশ বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। সাবের হোসেন চৌধুরী নিজেও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে এসব দেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
সূত্রের দাবি অনুযায়ী, তিন রাষ্ট্রদূত মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতাদের যদি অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়, তাহলে নির্বাচন আরও অংশগ্রহণমূলক এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হবে। যদিও কোনো পক্ষই এ বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেনি।
উল্লেখ্য, এর আগেও গত ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন (Tracy Ann Jacobson) গোপনে সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তখনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল ও দলীয় সংস্কার। তবে এর পরপরই ২৫শে মে সাবের হোসেন চৌধুরী’র উপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উত্থানের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) নেতৃত্বাধীন সরকারে এখনও রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদ্যমান। আওয়ামী লীগের বহু নেতা গৃহবন্দী, অনেকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, এবং হাজারো নেতাকর্মী গ্রেপ্তার বা সহিংস হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাবের হোসেন নিজেও ২০২৪ সালের অক্টোবরে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং পরে জামিনে মুক্তি পান। তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা, বিশেষ করে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক গোপন বৈঠক, আভাস দিচ্ছে যে, নিষিদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগ রাজনীতির অঙ্গনে ফেরার সুযোগ খুঁজছে।
এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের চলমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক মহলের নজরদারির মধ্যে এই বৈঠক শুধু আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নয়, বরং আগামী জাতীয় নির্বাচন ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে।