মাঠপর্যায়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা চায় সশস্ত্র বাহিনী

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিচারিক বা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ দায়িত্ব পালনের দাবি জানিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী (Armed Forces)। তাদের যুক্তি, এ ধরনের ক্ষমতা থাকলে মাঠপর্যায়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে, যা যে কোনো পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবে বলা হয়—রিটার্নিং কর্মকর্তা বা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যদি ভোটকেন্দ্রের ভেতরে সেনা সদস্যদের ডাকেন, তবে তারা যেন আইন অনুযায়ী সাড়া দিতে পারেন; এজন্য আইন, বিধিমালা ও পরিপত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি, বরং বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে।

নাশকতার আশঙ্কা ও এআই অপব্যবহার

বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, কোনো একটি দল নির্বাচনী পরিবেশ ভণ্ডুল করতে নাশকতা চালাতে পারে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হতে পারে বলেও জানানো হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, দেশের আট হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্র ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’। ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়।

তারা আরও জানান, সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ইতিবাচক হলেও জনগণের সঙ্গে আস্থা পুনর্গঠনে ইসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। পাশাপাশি ভোটের আগে ও পরে মোট আট দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে রাখার সুপারিশ আসে। সারা দেশের হেলিপ্যাডগুলো সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী রাখার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়।

ইসির নির্দেশনা ও নিরপেক্ষতার বার্তা

বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (Chief Election Commissioner) এএমএম নাসির উদ্দিন সভাপতিত্ব করেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে, এবং ইসি এবার কোনো গোপন নির্দেশনা দেবে না—সবকিছু হবে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছভাবে। একই সঙ্গে নিরপেক্ষতা রক্ষার ওপর জোর দেন তিনি।

সিইসি বলেন, একই এলাকায় দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ভোটের আগে বদলি করতে হবে। বিশেষভাবে আনসার বাহিনী (Ansar VDP)-তে যেন পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি (BGB), কোস্ট গার্ডসহ সব বাহিনীর প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। এটি বর্তমান কমিশনের প্রথম বড় পরিসরের আইনশৃঙ্খলা সভা।

সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার প্রস্তাব

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী যেন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকতে পারে—এমন প্রস্তাব করেন সশস্ত্র বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি জানান, ৫ আগস্ট থেকে সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে এ ক্ষমতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। তার প্রস্তাবকে সমর্থন করে আরও কয়েক বাহিনীর কর্মকর্তা বক্তব্য রাখেন।

প্রস্তাবে বলা হয়, সেনাবাহিনীর প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ সদস্য নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন। পাশাপাশি কোস্ট গার্ডের সঙ্গে নৌবাহিনীর সদস্যদেরও মাঠে রাখার সুপারিশ করা হয়। বিমানবাহিনী তাদের হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘোষণা দেয়।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, আগের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারবে, যা এখনকার কাঠামোতে সীমিত।

আইন ও ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং

ইসি সচিব জানান, সেনাবাহিনীর কাজের ধারা এখনো ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার অনুযায়ী চলছে। ইসি ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংয়ের ওপর জোর দিয়েছে, যাতে সব বাহিনীর সংগৃহীত তথ্য একত্রে ব্যবহৃত হয়। আরপিও সংশোধন শেষে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানান তিনি।

নিরাপত্তা, ড্রোন ও প্রযুক্তি ব্যবহার

জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জানান, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে থাকবে বডি ওর্ন ক্যামেরাসহ পুলিশ সদস্য। প্রশাসনিক কাজে ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি দিতে ইসিকে অনুরোধ করেন তিনি। পুলিশের আইজি জানান, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ চলছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ হবে।

ইসি সচিব বলেন, নির্বাচনি প্রচারণায় ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের কার্যক্রম দৃশ্যমান করার প্রস্তাবও বৈঠকে আসে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব

একটি বাহিনীর প্রধান সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্রে কিউআর কোড সংযোজনের পরামর্শ দেন, যাতে ভুয়া কার্ড শনাক্ত করা যায়। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিক নীতিমালা কঠোর করার সুপারিশ এবং কালোটাকার ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতার প্রস্তাব আসে।

ইসি সচিব জানান, এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে এনটিএমসি পূজার সময় যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিল, সেটি নির্বাচনেও প্রয়োগের সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি লেফট্যানেন্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি এয়ার ভাইস মার্শাল রুশাদ দিন আসাদ, নৌবাহিনীর প্রতিনিধি রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফট্যানেন্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানসহ পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *