জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে উত্তাপ, আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজন তুঙ্গে

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ২৫টি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে সনদে স্বাক্ষর করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনও অপেক্ষমাণ। তাদের অবস্থান পরিষ্কার—বাস্তবায়নের আইনি নিশ্চয়তা ছাড়া তারা স্বাক্ষর করবে না। এ প্রসঙ্গে দলটি বলছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়নে একটি সাংবিধানিক আদেশ প্রয়োজন, যা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) সরকারপ্রধান হিসেবে জারি করবেন।

সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, এনসিপিকে সনদে সই করাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) ও অন্যান্য দল যে আইনি ভিত্তির দাবি তুলেছে, তা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও একটি সাংবিধানিক আদেশ জারির চিন্তা করছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব শনিবারের মধ্যেই জমা দেওয়া হতে পারে।

সূত্র মতে, খসড়া আদেশটির নাম হতে পারে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ (সংবিধান)’—যা ১৭ই অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের স্বাক্ষরের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে। পরবর্তীতে গণফোরাম (Gonoforum) স্বাক্ষর করলেও সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ এখনো সনদে সই করেনি।

জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও মাঠে সরব জামায়াত। দলটির দাবি, জাতীয় নির্বাচন আগে হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। গণভোট হতে হবে তার আগে, কারণ এটাই জাতীয় নির্বাচনের মৌলিক ভিত্তি। তারা বলছে, একদিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে আইনগত জটিলতা দেখা দিতে পারে। এজন্য নভেম্বরের শেষ দিকেই গণভোট আয়োজনের দাবি জানায় জামায়াত।

এদিকে, বিএনপি (BNP) বলছে, সরকারপ্রধানের এমন কোনো আইনি ক্ষমতা সংবিধানে নেই। তাদের মতে, সরকার যেন এমন কোনো প্রস্তাব না দেয় যা দলগুলোকে সাময়িক শান্তি দিলেও ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি করবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার আইন জারি করার অধিকার নেই। কেউ যদি বলে, এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অর্ডার দিতে হবে, সেটা অযৌক্তিক।”

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আদেশে কী কী প্রশ্নে গণভোট হবে, তা উল্লেখ থাকবে। একাধিক ব্যালটে বিভিন্ন প্রশ্ন রাখা হতে পারে—যেমন, সনদ বাস্তবায়ন আদেশ চান কিনা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষের বিষয়, কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটির বিষয়ে জনগণের মত।

কমিশনের লক্ষ্য, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সুপারিশ সরকারকে প্রদান করা। ২৪শে অক্টোবরের মধ্যে এই প্রস্তাব জমা দিলে সরকার ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে আদেশ জারি করতে পারবে। কারণ ওই দিনই শেষ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ।

কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মতামতের ভিত্তিতে আমরা বাস্তবায়নের সুপারিশ করবো। আমাদের মূল বিবেচনা হচ্ছে—সরকার যেন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।”

তবে কমিশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যতই সুপারিশ করা হোক, সব দল তাতে রাজি হবে না। “সব দলকে খুশি করা সম্ভব নয়”—এই উপলব্ধি থেকেই সরকারকে শক্ত অবস্থানে যেতে বলছে কমিশন।

এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Citizens Party) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আমরা শুধু কাগজে লেখা সনদে বিশ্বাসী নই। সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা না পেলে আমরা স্বাক্ষর করবো না।” তিনি দাবি করেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের একমাত্র বৈধতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রয়েছে। প্রেসিডেন্টের নয়।”

জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “গণভোট ও নির্বাচন একসঙ্গে হলে জটিলতা হবে। গণভোট হচ্ছে মৌলিক সংস্কার নিয়ে, নির্বাচনে সিদ্ধান্ত হয় কে দেশ চালাবে।”

অন্যদিকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ।”

সব মিলিয়ে, জুলাই সনদ ঘিরে রাজনৈতিক ও আইনি হিসাব-নিকাশ এখন তুঙ্গে। এই সনদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সরকারের অবস্থান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত অংশগ্রহণের ওপর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *