গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব ও পেশ ইমাম মুহিবুল্লাহ মিয়াজী (Mohibullah Miyaji) সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল, তার পেছনের প্রকৃত ঘটনা অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে। পুলিশ এখন বলছে, এই ‘নিখোঁজ’ নাটকের পেছনে কোনো অপহরণ ছিল না—বরং খতিব মুহিবুল্লাহ নিজেই পঞ্চগড় গিয়েছিলেন।
গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) রাতে তাকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) অধীনে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়। তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার আসল তথ্য স্বীকার করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (Gazipur Metropolitan Police) এক কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকেন।
ওই কর্মকর্তার ভাষ্যে, প্রথমদিকে ইমাম মুহিবুল্লাহর নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে ইসকন (ISKCON) সংগঠনের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। তবে তদন্তে দেখা গেছে, তিনি অপহৃত হননি। বরং নিজেই শ্যামলী পরিবহন (Shyamoli Paribahan)-এর একটি বাসের টিকিট কেটে পঞ্চগড়ে চলে যান। তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের হেফাজতে আছেন বাসের এক সহযাত্রী ও বাসের সুপারভাইজারও।
তিনি আরও জানান, “ইমাম মুহিবুল্লাহ পুলিশের কাছে প্রকৃত ঘটনা স্বীকার করেছেন। তার দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। আজ (২৮ অক্টোবর) তাকে আদালতে তোলা হবে। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।”
উল্লেখ্য, গত ২২ অক্টোবর সকাল বেলা তিনি টঙ্গীর বাসা থেকে হাঁটতে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। পরদিন (২৩ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের সিতাগ্রাম হেলিপ্যাড এলাকায় মহাসড়কের পাশ থেকে শিকল বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি অপহরণ মামলা হয়।
এদিকে, এই ‘অপহরণ’ ঘটনার বর্ণনায় অসংগতি নিয়ে নতুন তথ্য সামনে এনেছেন আলজাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি (Zulkar Nain Sayer Sami)।
তিনি জানান, “মহিবুল্লাহ মিয়াজী নিজের অপহরণের বিষয়ে যে বিবরণ দিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।”
সায়ের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আরও বলেন, মুহিবুল্লাহ দাবি করেছিলেন, গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে তাকে টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে অপহরণ করা হয়। কিন্তু ফুটেজে দেখা যায়—
“সকাল ৬টা ৫২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে তিনি ঘর থেকে বের হন। বাম হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পেছনে না তাকিয়ে দরজাটি বন্ধ করেন। এরপর ৬টা ৫৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে মসজিদ ছাড়েন এবং ৬টা ৫৪ মিনিটে টঙ্গী টু কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কে রওনা হন কালীগঞ্জের দিকে। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, মাথায় ছিল কালো পাগড়ি।”
সায়েরের মতে, শিলমুন ফিলিং স্টেশনের চারটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও অপহরণের কোনো প্রমাণ নেই। বরং সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে মুহিব্বুল্লাহকে দ্রুত হাঁটতে দেখা গেছে পাম্পের সামনে দিয়ে।
তিনি বলেন, “ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স পথরোধ করে তাকে অপহরণের যে দাবিটি করা হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে এরকম কোনো দৃশ্য নেই। বরং তাকে একাই হাঁটতে দেখা গেছে। সামনের সেতুর উপরের পুলিশের স্থাপন করা ক্যামেরার ফুটেজেও মুহিবুল্লাহ একাই হাঁটছেন।”
মামলার এজাহারে মুহিব্বুল্লাহ উল্লেখ করেছিলেন, সকাল ৭টার দিকে তাকে অপহরণ করা হয়। কিন্তু সিসিটিভির সময় অনুযায়ী, তিনি ৬টা ৫৪ মিনিটে রওনা হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের ফিলিং স্টেশনে পৌঁছান ৭টা ১৮ মিনিটে।
ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার মো. সোলেইমান জানান, “তিন দফায় পুলিশের বিভিন্ন শাখা আমাদের সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ করে, আমাদের ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে হুজুরকে অপহরণ করা হয়নি।”
সুতরাং, ঘটনা যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট—এটি কোনো অপহরণ ছিল না, বরং একটি সাজানো নাটক ছিল, যার পর্দা এখন উঠতে শুরু করেছে।


