‘জুলাই সনদে নানা গোঁজামিল, ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ভীষণভাবে নষ্ট হয়েছে’—ড. শাহদীন মালিক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছে, তারা যে খসড়া দলিলে স্বাক্ষর করেছে এবং যে দলিল চূড়ান্ত হয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এটি নিছক বিভ্রান্তি নয়, বরং গুরুতর অভিযোগ—একটি দলিল দেখিয়ে স্বাক্ষর নেওয়া হলো, কিন্তু পরে ভিন্ন দলিল চূড়ান্ত করা হলো। বিএনপির দাবি সত্যি হলে, তথাকথিত ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

জুলাই সনদ ঘিরে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে আরও একটি বিষয়—এর সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিকতা। দেশের একজন খ্যাতিমান সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ বিষয়ে লিখেছেন, পুরো দলিলটি (যার দৈর্ঘ্য ২৫ পৃষ্ঠা, ৮৪টি ধারা) সাধারণ নাগরিকদের বোধগম্য নয়। তিনি সরাসরি বলেন, দেশের ১৫ শতাংশ ভোটারও এই সনদ পড়ে বুঝতে পারবেন না। এর ওপর আবার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট চাওয়ার ধারণা একেবারেই অযৌক্তিক।

বিশেষজ্ঞ আরও দাবি করেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাবিত ৪৮টি বিষয়ের অধিকাংশই বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বর্তমান সংবিধানে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলা হয়েছে, অথচ জুলাই সনদ বলছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে। তাহলে প্রশ্ন জাগে—এখন বলবৎ থাকবে কোনটি? বর্তমান সংবিধান, না জুলাই সনদের প্রস্তাব? যদি সনদের প্রস্তাব কার্যকর হয়, তবে বর্তমান সংবিধান বাতিল করতে হবে। অন্যথায় সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদ বা ধারা বলবৎ করা সংবিধানের বিপরীতে দাঁড়ায়—যা আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য।

বাংলাদেশের সংবিধানে ইতিপূর্বে ১৭টি সংশোধনী হয়েছে, যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ছয়টি সংশোধনী বাতিল করেছে সাংবিধানিক বিরোধের কারণে। সে বিবেচনায়, জুলাই সনদের ধারাগুলোও সহজেই বাতিলযোগ্য, যদি এগুলো বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এবং সংবিধান বাতিল করা না হয়।

একটি ধারা নিয়ে বিশেষজ্ঞের আপত্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। তা হলো, সনদে বলা হয়েছে—সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধনী পাস না করলে, সেটি ‘পাস হয়েছে’ বলে গণ্য হবে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন—তাহলে এত দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চলল কেন? পূর্বনির্ধারিত ফলাফলের জন্য কি এতকাল আলোচনার প্রয়োজন ছিল? তার মতে, এভাবে ‘গণতন্ত্রের অভিনয়’ করে বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব উপাদান যুক্ত করে পুরো প্রক্রিয়াটিকে জটিল ও অনির্ভরযোগ্য করে তোলা হয়েছে।

গণভোট: সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না থাকলে অর্থহীন
গণভোট একটি গুরুতর ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা হতে পারে কেবল একটি স্পষ্ট, একক প্রস্তাবের ওপর। যেমন—ব্রিটেনে বেক্সিট নিয়ে গণভোট হয়েছিল, যেখানে প্রশ্ন ছিল স্পষ্ট: ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকব কি না। কিন্তু বাংলাদেশে জুলাই সনদের প্রস্তাবের মতো ৪৮টি জটিল বিষয় নিয়ে একযোগে গণভোট করাকে তিনি “অবান্তর” বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তাঁর মতে, গণভোটের জন্য অবশ্যই একটি আলাদা আইন দরকার, যেটি বাংলাদেশে এখনো নেই। এই আইনের অনুপস্থিতিতে গণভোটের বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে এবং সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে—৪৮টি বিষয়ের ফলাফল গণনার পদ্ধতি কী হবে। অথচ এসব কিছুই সনদে স্পষ্ট নয়।

সাধারণত গণভোটের আগে সংসদে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব পাস করানো হয়। তার ভাষায়, গণভোট হয় সে সব বিষয়ে যেগুলো শুধু সংসদে পাস করলেই যথেষ্ট নয়, জনগণের মতামত নেয়া অপরিহার্য। প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত—গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংসদে আইন পাস। তা না করে সরাসরি গণভোট ডাকার নজির আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খুবই বিরল।

‘এলোমেলো সাংবিধানিক প্রস্তাব, আইনি বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার রূপরেখা’
বিশেষজ্ঞের মতে, এই সনদে এমন অনেক প্রস্তাব আছে, যেগুলো আইনেই নেই। সাংবিধানিক আদেশের যে কাঠামো তুলে ধরা হয়েছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এমনকি, বিচারব্যবস্থার চলমান শুনানি চলাকালেও সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাদের অধীনে চলবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও চলমান বিচারপ্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলেই মন্তব্য করেন তিনি।

এই পরিস্থিতিকে তিনি ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর আশঙ্কা, “এই গোঁজামিল ও এলোমেলো পরিস্থিতি থেকে দেশকে আইনি স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ২০ বছর লেগে যাবে।” দীর্ঘ সময় ধরে এই বিভ্রান্তিকর অবস্থার খেসারত দিতে হতে পারে জনগণকে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *