নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে করা আপিলের রায় আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করবে আপিল বিভাগ (Appellate Division)। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় দেবেন। আগে থেকে নির্ধারিত কার্যতালিকায় আপিল দুটি আজকের শুনানির ১ ও ২ নম্বরে রাখা হয়েছে।
গত ১১ নভেম্বর, দশম দিনের শুনানি শেষে রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করে সর্বোচ্চ আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আবেদনকারীদের আইনজীবীরা আশাবাদী, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে—যদিও তারা মনে করছেন, এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের নির্বাচন থেকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই আপিলে বিএনপি (BNP) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সিনিয়র আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্ভব নয়, কারণ সংসদ এক বছর আগে ভেঙে গেছে। তবে আমরা আশা করছি, ১৪তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে।”
প্রসঙ্গত, ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে আপিল গ্রহণ করেন। এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক পৃথক আপিল দায়ের করেন। ২১ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা দশ দিন শুনানি হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে বিএনপি সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে। ওই বছরের ২৭ মার্চ এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তবে ২০০৪ সালে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিনজন হাইকোর্টে রিট করেন, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলা হয়। পরে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রায় দেয় যে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
রিটকারী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, যার শুনানি শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেয়। ওই রায়ে বলা হয়, এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী এবং অগণতান্ত্রিক।
রায় অনুযায়ী, “তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে”—এমন পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, যেখানে সেই পর্যবেক্ষণ বাদ পড়ে। এরপর সেই পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিত্তিতেই দলীয় সরকারের অধীনে একের পর এক তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে, অবসরের সাত দিন আগে রায় দিয়ে তিনি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বৈধতা দিতে ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তীতে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) সেই রায়ের মাধ্যমে পরপর তিনবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ‘জুলাই অভ্যুত্থানে’ তার পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
সেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরই এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়। আজকের রায় সেই পুনর্বিবেচনার চূড়ান্ত রূপ। রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে গোটা দেশ। আইনজীবীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এখন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও জনগণের আস্থার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।


