জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি (BNP) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (Bangladesh Jamaat-e-Islami) তাদের মনোনীত প্রার্থী তালিকায় রদবদলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির ঘোষিত ২৩৭ জনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা থেকে ২৫ থেকে ৩০টি আসনে প্রার্থিতা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মনোনয়নবঞ্চিত সিনিয়র ও জনপ্রিয় নেতাদের সমন্বয় করতে ঢাকায় ডেকে আলোচনা করছে বিএনপি হাইকমান্ড। অন্যদিকে জামায়াতের তালিকায় আসতে যাচ্ছে ছাত্র রাজনীতি, নারী, সংখ্যালঘু ও ইসলামি স্কলারদের সংযোজন।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানান, মনোনয়ন ঘোষণার পর দলের ভেতরই সৃষ্টি হয়েছে কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ২৩টি আসনে হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল, পথ অবরোধ, কিছু কিছু আসনে হয়েছে সংঘর্ষও। চট্টগ্রাম, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় আহত হয়েছেন নেতাকর্মীরা। মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন এবং অনেকে সরাসরি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না করলেও হাইকমান্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছেন।
সদ্য প্রকাশিত প্রার্থী তালিকায় অনুপস্থিত ছিলেন বহু হেভিওয়েট নেতা যেমন—শামসুজ্জামান দুদু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আবদুস সালাম আজাদ, হাবিব উন-নবী খান সোহেল, রুমিন ফারহানা, আফরোজা আব্বাস, আব্দুল হাই প্রমুখ। তালিকায় ৮৪ জন নতুন মুখ থাকলেও তাদের অনেকের অভিজ্ঞতা, জনপ্রিয়তা ও মাঠ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যে সমস্ত আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করতে পারে দলটি।
আবার কয়েকটি আসনে তরুণদের বাদ দিয়ে বয়স্ক ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে ৮৮ বছর বয়সি প্রবাসী মুশফিকুর রহমানের মনোনয়ন ও কুষ্টিয়া-৪, চট্টগ্রাম-১৩, মুন্সিগঞ্জ-২ আসনে বয়োবৃদ্ধ প্রার্থীদের মনোনয়ন নিয়েও দলের মধ্যে রয়েছে প্রশ্ন। নেতারা বলছেন, তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে হলে প্রার্থীও হতে হবে প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
এদিকে বিএনপির অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতির জোনায়েদ সাকি, এলডিপির ড. রেদওয়ান আহমেদ, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতাদের জন্য ২০টির বেশি আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বিএনপি। কয়েকটি আসনে শরিকদের পক্ষে প্রার্থীতা নিশ্চিত বলেও জানিয়েছে বিএনপির একাধিক সূত্র।
মনোনয়ন নিয়ে সংকট নিরসনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (Tarique Rahman) সরাসরি ফোনে কথা বলছেন মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, কুমিল্লা-৯, সাতক্ষীরা-৩, ময়মনসিংহ-৬, নাটোর-১, রাজশাহী-৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, জয়পুরহাট-১ ও ২ আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বড়সড় পরিবর্তনের প্রস্তুতি। তাদের পূর্বঘোষিত তালিকায় বিদ্রোহী না থাকলেও এবার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে নতুন মুখ, কিছু মুখ চেনা বক্তা, ছাত্রনেতা ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের। তালিকায় রয়েছে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিপি, দুজন জিএস, পাঁচজন সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তাদের নাম। আলোচনায় রয়েছেন মিজানুর রহমান আজহারি (Mizanur Rahman Azhari) ও আমির হামজা (Amir Hamza)। জামায়াত সূত্র বলছে, এরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও তাদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চায় দলটি। মিজানুর রহমান আজহারি জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে ঢাকা-৫ আসনে ভোটযুদ্ধে নামছেন এমন খবর প্রচারিত হলেও শেষ পর্যন্ত এ খবরের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
জামায়াত এবার অমুসলিম ও নারী প্রার্থী দেওয়ার দিকেও নজর দিচ্ছে। এছাড়া একজন উপজাতি প্রার্থী দেয়ারও চিন্তা চলছে। এছাড়াও চূড়ান্ত তালিকায় উচ্চশিক্ষিত ও পরিচিত কয়েকজন নারীকে প্রার্থী হিসাবে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে জামায়াত ও শরিকদের আসন ভাগাভাগি নিয়েও চলছে আলোচনা। প্রাথমিকভাবে ১০০ আসন ছাড়ার কথা বলা হলেও বর্তমানে যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিজয়ী হতে পারে এমন প্রার্থীকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় ৮ দলের মধ্যে কাউকে মনোনয়ন দিলেই বাকিরা তার পক্ষে কাজ করবে – এমনটাই মনে করছেন জামায়াত নেতারা।
সব মিলিয়ে নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও তৃণমূলের চাপ, অন্যদিকে নির্বাচনী বাস্তবতা—সবকিছুর সমন্বয় করেই চূড়ান্ত তালিকা দিতে যাচ্ছে উভয় দল। তবে বিএনপি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—“কোথাও বিরোধ রাখতে চাই না”।


