সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মত করে নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হতে হবে ‘জুলাই সনদ’র উপর: এনসিপি

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বৃহস্পতিবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ত্রয়োদশ সংশোধনীর আদলে নয়, বরং ‘জুলাই সনদ’ অনুযায়ীই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়া উচিত।

রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন (Akhtar Hossain) বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে জানিয়েছি—সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো নয়, বরং ‘জুলাই সনদে’ যেভাবে বলা হয়েছে, সেই কাঠামোতেই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু করতে হবে।”

“ত্রয়োদশ নয়, জুলাই সনদের ফর্মুলা বাস্তবসম্মত”

আখতার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি কার্যকর পদ্ধতির অভাব বরাবরই ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই শূন্যতা পূরণে একটি ঐতিহাসিক উদ্ভাবন। নব্বইয়ের দশকে এই ব্যবস্থা চালু হলেও, পরবর্তীতে হাসিনা সরকার আদালতকে ব্যবহার করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তা ধ্বংস করে দেয়। এর ফলেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচন হয়, যা দেশে ফ্যাসিবাদের পথ খুলে দেয়।”

তিনি উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক রায়কে স্বাগত জানালেও সতর্ক করে দেন যে, এই রায় যেন অতীতের ভুল পথে না যায়। “ত্রয়োদশ সংশোধনীর কাঠামো বিচার বিভাগের ওপর অতিনির্ভরশীল ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে নিজেদের মতো করে উপদেষ্টা মনোনয়ন দিতে বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়িয়েছিল। এর ফলেই এক-এগারোর মতো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল।”

জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক গঠনের ভিন্ন প্রক্রিয়া

আখতার হোসেন জানান, এনসিপির হাতে জুলাই সনদের খসড়া পৌঁছেছে। “এই সনদে সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের অংশগ্রহণে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ফর্মুলা রয়েছে। শুধু বিচার বিভাগের ওপর নির্ভর না করে রাজনৈতিক ভারসাম্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করার লক্ষ্যে এই সনদ গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি আরও বলেন, “র‌্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের” মতো একটি আধুনিক নির্বাচনী পদ্ধতির কথাও সেখানে বলা হয়েছে, যদিও বিএনপি (BNP) এই অংশে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, এখনও সব দল পুরোপুরি ঐক্যমতে পৌঁছায়নি।”

সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ জানাল এনসিপি

সংবাদ সম্মেলনে আখতার হোসেন জানান, এনসিপি এখনো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “সনদে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে, বিশেষ করে আদালতের সাম্প্রতিক রায়ের পর এটি পরিষ্কার নয়—তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী, না কি জুলাই সনদের কাঠামো অনুযায়ী।”

তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, এই বিষয়টি দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে, এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। “এই স্পষ্টতা এলে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য দৃঢ় হলে, আমরা সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত থাকবো।”

উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র নেতারাও

সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর দেশের রাজনৈতিক ময়দানে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ‘জুলাই সনদ’ এবং ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী’—এই দুটি রূপরেখার মধ্যে কোনটি কার্যকর হবে, তা নিয়েই এখন মূল বিতর্ক। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপির অবস্থান ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চুক্তি ও কাঠামোগত সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *