দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার (Begum Khaleda Zia) অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের (Tarique Rahman) দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অনেকটাই কৌশলী হয়ে উঠেছে বিএনপি (BNP)। নির্বাচনী আইন আরপিও’র বাধ্যবাধকতার কারণে এবার জোট সঙ্গীদের ধানের শীষ বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হচ্ছে। ফলে প্রার্থিতা বাছাইয়ে বিএনপি দলীয় প্রার্থীদেরই প্রাধান্য দিচ্ছে।
এই কৌশলেরই প্রতিফলন দেখা গেছে বৃহস্পতিবার ঘোষিত নতুন মনোনয়ন তালিকায়, যেখানে ৩৬টি আসনের মধ্যে সবকটিতেই বিএনপির নিজস্ব প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, এখনো ২৮টি আসন খালি রাখা হয়েছে, যার মধ্যে জোট শরিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কিছু আসন ভাগ করা হতে পারে। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন—জোট শরিকদের জন্য ২০টির বেশি আসন ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেই, এবং প্রয়োজন হলে এই সংখ্যাও আরও কমানো হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির ঘোষিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে—৩০০ আসনের মধ্যে ২৭২টিতে দলের প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, বাকি থাকা ২৮টি আসন আসলেই শরিকদের জন্য রাখা হয়েছে কিনা, নাকি কৌশলগত কারণে পরবর্তীতে এখানেও বিএনপি নিজস্ব প্রার্থী দেবে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চর্চায় আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens’ Party)-র সঙ্গে বিএনপির সম্ভাব্য জোট। নতুন তালিকায় বিএনপি যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, ভবিষ্যতে জোট হলে সেই আসনগুলো থেকে প্রার্থী বাদ দেওয়া হবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir) জানিয়েছেন, “যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।”
তার কথার প্রতিফলন দেখা যায় ঢাকা মহানগরীর আসনগুলোর বেলায়ও। বিএনপি প্রথম দফায় ঢাকায় ছয়টি আসন ফাঁকা রেখেছিল। এরপর নতুন তালিকায় চারটি আসনে প্রার্থী দিলেও ঢাকা-১৩ ও ঢাকা-১৭ এখনো ফাঁকা রাখা হয়েছে। ঢাকা-১৩ আসনে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ (Bobby Hajjaj) প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির ‘গ্রিন সিগন্যাল’ নিয়ে, এবং ঢাকা-১৭ আসনে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির আন্দালিব রহমান পার্থ (Andaleeve Rahman Partho)।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনেও বিএনপি প্রার্থী দেয়নি। এই আসনে গণসংহতি আন্দোলন (Gonoshonghoti Andolon)-এর প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি (Zonayed Saki) প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা চলছে।
তালিকার আরও ফাঁকা থাকা আসনের মধ্যে রয়েছে বগুড়া-২ ও চট্টগ্রাম-১৪। এই দুটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন মাহমুদুর রহমান মান্না (Mahmudur Rahman Manna) এবং অধ্যাপক ওমর ফারুক, যিনি এলডিপি সভাপতি অলি আহমদের (Oli Ahmed)-এর ছেলে।
এছাড়া পটুয়াখালী-৩ এবং ঝিনাইদহ-২ আসনে বিএনপি এবারও প্রার্থী দেয়নি। এখানে জোটভুক্ত গণঅধিকার পরিষদ (Gonoadhikar Parishad)-এর সভাপতি নুরুল হক (Nurul Haque) এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান (Rashed Khan) মনোনয়ন পেতে পারেন।
জোট শরিকদের আরও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন—পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার (Mostafa Jamal Haider), লক্ষ্মীপুর-১ আসনে এলডিপি চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র সাহাদাত হোসেন সেলিম (Shahadat Hossain Selim)।
তবে সব আলোচনার মাঝেও কিছু আসনে বিএনপি জোট শরিকদের আবেদন উপেক্ষা করেছে। যেমন ঢাকা-৭ আসনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (Bangladesh Khelafat Majlish)-এর আমির মামুনুল হক আলোচনায় থাকলেও বিএনপি সেখানকার প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। একইভাবে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা এবং ঝালকাঠি-১ আসনে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বিএনপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এসব আসনেও বিএনপি নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে—আগামী নির্বাচনে জোট রাজনীতি থাকলেও বিএনপি এবার আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে অনেক বেশি রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে। একদিকে ধানের শীষ প্রতীকের আধিপত্য বজায় রাখা, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকটে নিজেদের ঘুঁটি শক্ত করে সাজানো—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ের কৌশলেই এগোচ্ছে বিএনপি।


