নতুন বিরোধী শক্তির পথভ্রষ্টতা: এনসিপির অঙ্কে মিলছে না হিসেব

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগের একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রতিপক্ষ ছিল বিএনপি (BNP)। কিন্তু ৫ আগস্টের ঘটনার পর যখন বিএনপিকে পরবর্তী ক্ষমতার একমাত্র দাবিদার হিসাবে মনে করা হতে থাকে তখন নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে দুটি ভিন্নমুখী রাজনৈতিক সত্তা—একদিকে পুরনো খেলোয়াড় জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami), অন্যদিকে নবাগত ও তরুণ নেতৃত্বনির্ভর এনসিপি (NCP)। দুটোই নিজেদের “বিকল্প বিরোধী শক্তি” হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় তাদের অবস্থান ও কৌশল নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।

জামায়াত: আদর্শের মুখোশে পুরনো রাজনীতি
৫ আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জামায়াত একটি নতুন নৈতিক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে। “এক জালিমের বিদায় হয়েছে, আরেক জালিম আসুক, সেটা আমরা চাই না”—এই স্লোগান তুলে তারা এক ধরনের “ঊর্ধ্ব নৈতিকতা” দাবি করলেও বাস্তবতায় তারা জানে, তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি সংকুচিত, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দুর্বল, এবং জনসম্পৃক্ততা প্রায় নেই বললেই চলে।

এই বাস্তবতায় জামায়াত কিছুদিন “তৃতীয় পথ” নাটক করলেও শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে গেছে বিএনপি-নির্ভর প্ল্যাটফর্মে। তারা বুঝেছে, একা কিছুই সম্ভব নয়।

নতুন মুখ এনসিপি: সাহস আছে, কৌশল কি ঠিক?
জামায়াতের তৈরি করা শূন্যস্থানে একধরনের প্রাকৃতিক প্রবাহে উঠে এসেছে এনসিপি—নতুন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যারা তরুণ নেতৃত্বের মুখ হয়ে উঠতে চায়। তারা নিজেদের আলাদা এক বলয় হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে, যেখানে পুরনো দুই পক্ষ—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয়কেই সমানভাবে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বিএনপিকেও তারা আওয়ামী লীগের সমতুল্য অপরাধী হিসেবেই দেখে। এই “দুই পক্ষই বাতিল” দর্শন, কিছু তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও, বাস্তব রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত জটিল এক অবস্থান।

বিষয়টা হলো, তারা একদিকে নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থাপন করতে চায়, অথচ কার্যত আওয়ামী লীগের পক্ষে সুবিধা তৈরি করে ফেলছে। কারণ তারা বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করতে চায়, অথচ নিজেরা মাঠে একা দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষমতাসীনদের সহজ টার্গেট হয়ে যাচ্ছে।

দুই দিকেই ঝুঁকি
এনসিপি যদি বিএনপিকে কোণঠাসা করার অবস্থানে থাকে, তাহলে তারা দুই দিক থেকে চাপে পড়ে:

  1. আওয়ামী লীগ তাদের দমন করতে সময় নেবে না। কারণ বর্তমান বাস্তবতায়একা থাকা মানেই দুর্বলতা, এবং রাজনৈতিক মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকা মানে একমাত্র টার্গেট হয়ে যাওয়া।

  2. বিএনপিও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখবে, সহযোদ্ধা নয়। ফলে কোনো যৌথ আন্দোলনে সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

আদর্শিক স্বপ্ন বনাম বাস্তব রাজনীতি
এনসিপি নিজেদের “নতুন রাজনীতি”—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও স্বাধীন চিন্তার পতাকাবাহী বলেই পরিচয় দিচ্ছে। এই আদর্শ নিয়ে তারা যদি আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়, তাহলে সেই আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সময় লাগবে না। আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান—দমন-পীড়ন, দলীয়করণ ও দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি—কোনোভাবেই “নতুন রাজনীতি”র সঙ্গে খাপ খায় না।

তবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত বিচ্ছিন্ন একটি কৌশলগত জোট, এনসিপির জন্য অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। এতে তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেই বিরোধী বলয়ে থাকতে পারবে, আবার জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিজেদের আদর্শিক অবস্থানও পরিষ্কার করতে পারবে।

রাজনীতির অঙ্কে এখনো গড়মিল
রাজনীতিতে একা চলার সাহস থাকা ভালো, কিন্তু যখন সেই সাহস কৌশলহীন হয়, তখন সেটা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। এনসিপি যদি সত্যিই টিকে থাকতে চায়, তাহলে তাদের ভাবতে হবে—“বিএনপি-বিরোধিতা” কেন করছে, কীভাবে করছে এবং সেটার পরিণতি কী হতে পারে।

কারণ তারা যাদের বিরোধিতা করছে, তারাই হয়তো একমাত্র সেইফ গার্ড হতে পারত ভবিষ্যতে। একা চলার রাজনীতি রোমান্টিক শোনাতে পারে, কিন্তু এককালে সেই পথেই সবচেয়ে বেশি আত্মঘাত ঘটে।

ডাঃ ফেরদৌস কবির
সম্পাদক: তাজাখবর.কম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *