জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন (Local Government Reform Commission)। তবে কমিশনের মতে, আগে প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার—নয়তো নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে না। আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-এর হাতে কমিশনের ৫১টি সুপারিশ সম্বলিত প্রায় পাঁচ শত পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে তারা। এই প্রতিবেদনে একসঙ্গে পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, যেটি একই আইনের আওতায় পরিচালিত হবে।
কমিশনপ্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ (Dr. Tofail Ahmed) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “নির্বাচনের আগেই কাঠামোগত সংস্কার না হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়বে।”
এক আইনে পাঁচ প্রতিষ্ঠান, একসঙ্গে নির্বাচন
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা আলাদা আইনে পরিচালিত হলেও এখন একক আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি আইনের খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।
সব নির্বাচন এক তপশিলে হলে ব্যয় এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে বলেও সুপারিশে বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২২৫ দিনের জায়গায় ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় ২৩০০ কোটির পরিবর্তে মাত্র ৬০০ কোটি টাকায় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব বলে কমিশনের গণনা। এতে প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস পাবে এবং কাজের গতি বাড়বে।
দলীয় প্রতীক নয়, সরকারি কর্মকর্তার অংশগ্রহণ সীমিত
এই নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে হবে না বলেও জানানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদেরও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তারা চেয়ারম্যান বা মেয়রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হতে পারবেন না।
আলাদা পুলিশ বাহিনী ও আর্থিক বরাদ্দ
কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব হলো, চৌকিদার প্রথা বিলুপ্ত করে স্থানীয় সরকারের জন্য আলাদা পুলিশ বাহিনী গঠন করা। একজন অতিরিক্ত আইজিপির অধীনে এই বাহিনী পরিচালিত হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনে এই বাহিনী ব্যবহার করতে পারবে।
এছাড়াও প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারের প্রাপ্ত মূল্য সংযোজন করের এক তৃতীয়াংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ দিতে হবে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসবে বলে মনে করে কমিশন।
ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাস
প্রতিবেদনে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাসের কথাও বলা হয়েছে। বর্তমানে কোনো ইউনিয়নে রয়েছে ৫ হাজার জনসংখ্যা, আবার কোথাও ৫ লাখ। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়িয়ে ৯ থেকে ৩৯টি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি বহুমুখী কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক একসঙ্গে পরিচালিত হবে।
স্থায়ী সংস্কার কমিশনের পক্ষে মত
কমিশন মনে করে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে একটি স্থায়ী সংস্কার কমিশন প্রয়োজন, যারা নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে কাঠামো ও কার্যাবলি উন্নয়নের কাজ করবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর ১৮ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর আগেই ১৯ ফেব্রুয়ারি কমিশনপ্রধান একটি সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
সংসদ নির্বাচনের আগে নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ, জাতীয় নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। আগে একটা, পরে। একটা করলে আরেকটা করতে পারব না, এ জাতীয় শর্তই আমার মনে হয় অমূলক কথা। দুটাই করতে হবে। কোনটা আগে কোনটা পরে, এটার সিদ্ধান্ত সরকার এবং ওনারা (রাজনৈতিক দল) নেক।’