পারভেজ হত্যাকারীদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে উমামাদের ‘ভিকটিম ব্লেইমিং’

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজনীতি। একদিকে নিহত পারভেজের পরিবার ও ছাত্রদল এ ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছে, অন্যদিকে উমামা ফাতেমা (Umama Fatema) নেতৃত্বাধীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন (Anti-Discrimination Student Movement) বলছে, তাদের সংগঠনকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে।

রোববার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর বাংলামোটরে নিজ সংগঠনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উমামা অভিযোগ করেন, পারভেজ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘ছাত্রদল একটি পরিকল্পিত বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হোক, অপরাধীরা শাস্তি পাক, এতে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আমাদের সংগঠনকে টেনে এনে যেভাবে মিডিয়া ট্রায়াল চলছে, সেটা একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

উমামা বলেন, ভিডিও ফুটেজে পুরো ঘটনাটি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। “নিহতের পরিবার যাদের নাম দিয়েছে, আমরা তাদের পক্ষে সাফাই গাইছি না। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে যে ন্যারেটিভ চালানো হচ্ছে, সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” তিনি দাবি করেন, তাদের সংগঠনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের গণআন্দোলনের জায়গা কলঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে।

এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।

পারভেজের পরিবারে শোকের মাতম
অন্যদিকে, নিহত পারভেজের পরিবার এখনো স্বজন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান। রবিবার বিকেলে ময়মনসিংহের ভালুকার কাইচান গ্রামে মরদেহ পৌঁছানোর পর মা পারভীন আক্তার বারবার মূর্ছা যান, জ্ঞান ফিরলেই আহাজারি করে বলেন, “আমার পুতেরে আইনা দাও, আমি একটাবার মা ডাক শুনবার চাই।” বাবা জসিম উদ্দিন বলেন, “যদি আমার পুতেই না থাকে, আমি বাইচ্চা থাইক্কা লাভ কী? যারা আমার পুতেরে মারছে, তাদের ফাঁসি চাই।”

রবিবার রাত ১০টার দিকে গ্রামে দাফন হয় পারভেজের লাশ। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে মরদেহ নেওয়া হয় বিএনপি (BNP) কার্যালয়ের সামনে। সেখানে জানাজা শেষে মরদেহ পৌঁছায় প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে গ্রামে পাঠানো হয়।

পুলিশ জানায়, পারভেজের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবীর বনানী থানায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয়ে আরও ২৫-৩০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

এজাহার অনুযায়ী, শনিবার বিকেল ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাসাহাসিকে কেন্দ্র করে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়। ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রীর সামনে পারভেজ ও তার বন্ধুরা হাসছিলেন, যা দেখে অভিযুক্ত মেহেরাজ, পিয়াস ও মাহাথির আপত্তি তোলেন। ঘটনার একপর্যায়ে শিক্ষকরা সালিশ করলেও পরে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে অভিযুক্তরা বহিরাগতদের সঙ্গে এসে পারভেজ ও তার বন্ধুকে মারধর ও ছুরিকাঘাত করেন।

পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বন্ধু তরিকুল এখনো চিকিৎসাধীন।

এই ঘটনায় যেসব নাম উল্লেখ রয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক সোবহান নিয়াজ তুষার, যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজি এবং মেহেরাজ, পিয়াস, মাহাথির, রিফাত, আলী ও ফাহিম। রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে একাধিক দল কাজ করছে। বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার জানান, অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী আসামিদের গ্রেপ্তার ও দ্রুত বিচার দাবিতে থানায় এসেছিলেন।

ছাত্রদলের বিক্ষোভ কর্মসূচি
রোববার নয়াপল্টনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল (Chhatra Dal) সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, “খুনিদের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাসহ সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।” আজ সোমবার সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ও সমাবেশের ডাক দিয়েছে ছাত্রদল।

এ ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকায় এবং বনানীর কাকলী এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেও শিক্ষার্থীদের অবস্থান দেখা যায়।

এই ঘটনায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছে ছাত্র রাজনীতির ভেতরে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। উমামার বক্তব্য যেখানে আত্মপক্ষসমর্থনের ভাষা, সেখানে ছাত্রদলের ভাষা—রক্তের ন্যায়বিচারের দাবি। এখন দেখার বিষয়, তদন্ত কতদূর এগোয়, এবং এই মৃত্যুর দায় শেষ পর্যন্ত কার ঘাড়ে পড়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *