রাজনৈতিক অঙ্গনে সদ্যপ্রকাশিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Civic Party) যেন শুরুতেই ধাক্কা খাচ্ছে নেতৃত্বের সংকট ও সাংগঠনিক অচলাবস্থায়। জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণদের উদ্যোগে গঠিত এ দলের বয়স এখন মাত্র আড়াই মাস। নতুন দল হিসেবে সময় চাওয়া স্বাভাবিক হলেও, প্রকাশ্য মতপার্থক্য, আদর্শগত বিভাজন ও তৃণমূল কার্যক্রমের দৃশ্যমান অভাব এনসিপিকে ঘিরে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে—আসলে তারা কতটা প্রস্তুত?
আশাবাদের জায়গা থেকে এনসিপির যাত্রা শুরু হলেও দ্রুতই সামনে আসে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন। নেতৃত্বের চারটি স্তরে বিভক্ত ২১৮ সদস্যের বিশাল কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রমের হদিস মিলছে না। ঢাকার বাইরে কমিটি নেই, অথচ সামাজিক মাধ্যমে নেতারা সরব। শীর্ষ পর্যায়ে মুখ্য সমন্বয়ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলের মুখ্য সংগঠকরা রয়েছেন, তবে কর্মী ও নেতৃত্বের মাঝে যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিলম্ব স্পষ্ট।
নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপি গঠন হয় মূলত বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আদর্শগত ভিন্নতা ও তৃণমূলে সংগঠনের অভাব দলটির গতিপ্রকৃতি থমকে দিয়েছে।
তরুণ নেতৃত্বে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব
এনসিপির নেতাদের অনেকেই এসেছেন বিভিন্ন আদর্শিক ছাত্রসংগঠন থেকে—ছাত্রশিবির (Islami Chhatra Shibir), ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল, রাষ্ট্রচিন্তা, গণ অধিকার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীসহ নানা পন্থার রাজনীতির পথ পেরিয়ে এক প্ল্যাটফর্মে এসেছেন তারা। ফলে দলটির অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ দলটিকে মধ্যপন্থার দাবি করলেও, স্পষ্টতই বিভাজনের রেখা দেখা যাচ্ছে ডানপন্থী ও বাম ঘরানার নেতাদের মাঝে।
শুধু আদর্শ নয়, দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াতেও মতবিরোধ লক্ষণীয়। কমিটি গঠনে বলয়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ, কর্মসূচি ঘোষণায় দ্বিধা, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য—এসব ইঙ্গিত দেয়, দলটি এখনো অভ্যন্তরীণ ঐক্যের সন্ধানেই ব্যস্ত।
জমে ওঠেনি মাঠের সংগঠন
এনসিপির দাবি অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে সংগঠনের প্রাথমিক ভিত্তি থাকলেও এখনো পর্যন্ত জেলা-উপজেলায় দৃশ্যমান কোনো সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। সংগঠনের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ জানান, চলতি মাসের মধ্যেই তৃণমূল কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন করা হবে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্য ঈদের আগেই বড় কমিটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে।
অন্যদিকে সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানান, সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়াতে দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এখনও পর্যন্ত সেসব অঞ্চলে রাজনৈতিক সক্রিয়তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
সামাজিক মাধ্যমে সরব, বাস্তবে অনুপস্থিত
দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা অনেক নেতা ফেসবুক-ভিত্তিক তৎপরতায় সক্রিয় থাকলেও বাস্তব রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে হাসনাত ও সারজিস আলমের পরস্পরবিরোধী পোস্ট, নারীর অধিকার নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য এবং বাম দলগুলোর কর্মসূচিতে একপক্ষের অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে দলটির শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সাত দফা অবস্থান
সম্প্রতি নাহিদ ইসলাম নেতৃত্বাধীন শীর্ষ বৈঠকের পর এনসিপির পক্ষ থেকে সাতটি মূল অবস্থান ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মতন্ত্র বা সেক্যুলারিজম নয় বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহাবস্থান, ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরোধিতা, বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ও দুর্নীতিমুক্ত ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি উঠে আসে ওই বিবৃতিতে।
বিভাজনের ইতিহাস
এনসিপির পথচলা শুরু হয় ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচন থেকে। এরপর রাষ্ট্রচিন্তা, গণ অধিকার পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ছাত্রশক্তি হয়ে শেষে আসে এনসিপি। এ দীর্ঘ পথচলায় আদর্শগত দ্বন্দ্বে ভেঙেছে সংগঠন, জন্ম নিয়েছে নতুন প্ল্যাটফর্ম। যেমন আলী আহসান জুনায়েদের নেতৃত্বে ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)’ তৈরি হয়েছে, আবার রয়েছে জুলাই মঞ্চ ও জুলাই ঐক্যের মতো প্ল্যাটফর্মও।
ফলে দেখা যাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো এখন বিভক্ত। এনসিপি তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চাইলেও আদর্শগত সমন্বয়, নেতৃত্বে ঐক্য এবং তৃণমূল ভিত্তির অভাব তাদের সেই অভিযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।