গত বছরের রাজনৈতিক সমীকরণ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশকে বিচার করা এখন আর সম্ভব নয়: অর্ক ভাদুড়ী

বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার পটভূমিতে উঠে এসেছে দুটি বিপরীতমুখী রাজনৈতিক বলয়ের সংঘর্ষ। বিশিষ্ট সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ী (Arko Bhadhuri) তাঁর সাম্প্রতিক এক ফেসবুক পোস্টে দেশের চলমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—গত বছরের রাজনৈতিক সমীকরণ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশকে বিচার করা এখন আর সম্ভব নয়।

দেশে এখন মূলত দুটি শক্তিবলয় কার্যকর। একদিকে রয়েছে বিএনপি, একটি বড় বামপন্থী অংশ এবং সেনাবাহিনী। অন্যদিকে আছে ইউনুস সরকার (Yunus Government)-ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক শক্তির জোট। দুই বলয়ের মধ্যেই ‘নাগরিক সমাজ’-এর ব্যক্তিরাও যুক্ত।

মূল সংঘাত: নির্বাচন ও বৈধতার প্রশ্নে মুখোমুখি দুই পক্ষ
এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। বিএনপি, বামপন্থীরা এবং সেনাবাহিনী দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তাঁদের মতে, দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ার কারণেই জনগণের ক্ষোভ তুঙ্গে। প্রাণ দিয়ে ভোটের অধিকার দাবি করেছিল মানুষ। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সেই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, তাহলে আরেকটি গণআন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে, ইউনুস সরকার বলছে তারা কোনও টালবাহানা করছে না। আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের।

রোহিঙ্গা সংকট ও বিদেশি ‘মানবিক করিডোর’ নিয়েও তীব্র বিতর্ক
এদিকে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘মানবিক করিডোর’ চালুর প্রস্তাব দিয়েছে, যার তীব্র বিরোধিতা করেছে বিএনপি ও বাম দলগুলি। তাদের বক্তব্য—এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে থাকা উচিত নয়, বরং একটি নির্বাচিত সরকারই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বামপন্থীদের মতে, এই করিডোর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করবে এবং এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ইতোমধ্যেই ‘মা মাটি মোহনা/ বিদেশিদের দেব না’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

আইনশৃঙ্খলা, সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও নারী নির্যাতনের অভিযোগ
বিএনপি এবং বামপন্থীদের আরেক অভিযোগ—এই সরকার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। সংবিধান সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং একটি অবাধ নির্বাচনের আয়োজন—এই তিন দায়িত্বের একটিতেও সরকার সফল হয়নি। বরং নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, মাজার ভাঙচুর এবং ডানপন্থীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। শ্রমিক ও ছাত্রদেরও দমন করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ
সম্প্রতি সবচেয়ে বিস্ফোরক দিকটি উঠে এসেছে সেনাবাহিনীর অন্দরের উত্তেজনা। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সেনাপ্রধান ওয়াকারের সমান্তরালে একটি প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চাইছেন। যদিও এ দাবি যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে সেনাবাহিনীর একাংশ মনে করছে, তাদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত ‘মানবিক করিডোর’ ইস্যুতে তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি।

এই পটভূমিতে সেনাপ্রধান একটি কড়া বার্তা দিয়েছেন, যেখানে তিনি রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এই অবস্থান বিএনপি ও বামপন্থীদের সুরের সঙ্গেও মিলে যায়।

ইউনুসের পদত্যাগের গুঞ্জন ও সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক
এই নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে শোনা যাচ্ছে, ইউনুস (Yunus) পদত্যাগের কথা ভাবছেন। সরকারঘনিষ্ঠ মহলের দাবি—তাঁর বিদায় হলে দেশ ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়বে। তবে বিএনপি বলেছে, তারা ইউনুসের পদত্যাগ চায় না, কিন্তু যদি তা হয়, তাহলে জনগণ বিকল্প পথ খুঁজে নেবে।

এই পরিস্থিতিতে আজ সন্ধ্যায় একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আয়োজন করেছেন ইউনুস। সেখানে বিএনপি, জামাত, এনসিপি, কমিউনিস্ট পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি-সহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি প্রত্যাশিত।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াবে, তার অনেকটাই নির্ধারিত হবে এই দুই বলয়ের মধ্যকার চলমান সংঘাত এবং সেনাবাহিনীর অবস্থানের উপর। ১০ মাস আগের রাজনৈতিক সমীকরণ এখন আর কার্যকর নয়। কেউ কেউ বলছেন, এই সময়টিকে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া’-পরবর্তী সময়ের সাথেও তুলনা করা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *