ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক (Tulip Siddiq) নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও, তার সাম্প্রতিক পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। সোমবার দুদকের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন, তবে তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেন কেন?”
মোমেন বলেন, “তার আইনজীবী যদি আমাদের কাছে চিঠি লেখেন, তাহলে বুঝতে হবে—তিনি আমাদের এখতিয়ার স্বীকার করছেন। আমরা তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করছি, কারণ আয়কর রিটার্ন ও অন্যান্য নথিতে সেই তথ্য রয়েছে।”
তিনি জানান, টিউলিপ সিদ্দিক-এর বিরুদ্ধে দুদকের তিনটি মামলা চলমান এবং আরও একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে একটি মাছের খামার থেকে ৯ লাখ টাকা আয়ের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত, যা তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ রয়েছে।
সন্দেহজনকভাবে নাগরিক পরিচয় বদল
দুদক চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, “একবার ব্রিটিশ, আবার বাংলাদেশি পরিচয় গ্রহণ—এটা স্পষ্টভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। আইন অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই।” তিনি আরও জানান, গুলশানে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ এবং রাজউকের মাধ্যমে সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে টিউলিপের বিরুদ্ধে।
স্বর্ণের হিসাবেও অস্বাভাবিকতা
দুদক প্রধান বলেন, টিউলিপের আয়কর রিটার্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তার সোনার পরিমাণ হঠাৎ ১০ ভরি থেকে বেড়ে ৩০ ভরি হয়ে গেছে, কিন্তু সোনার বাজারমূল্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। “এই অস্বাভাবিক সম্পদবৃদ্ধি নিয়ে তাকে জবাবদিহি করতে হবে আদালতে,”—জানান তিনি।
সাক্ষাৎ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত
মোমেন বলেন, টিউলিপের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। “কারণ, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি দেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে না—এটি আইন পরিপন্থী। প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাসহ তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা পদ্ধতিগতভাবে তলবি নোটিশ, সমন ও ওয়ারেন্ট পাঠাচ্ছি। তার আইনজীবীকেও জানিয়ে দিয়েছি—আমাদের দেশের আইনের আওতায় তাকে বিচার মোকাবিলা করতেই হবে।”
মামলার পটভূমি
গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)। এরপর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina), তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (ACC)।
এরই ধারাবাহিকতায়, গত ১৫ এপ্রিল টিউলিপের বিরুদ্ধে ঢাকার গুলশানে একটি প্লট অবৈধভাবে হস্তান্তরের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়। অভিযোগে বলা হয়, তিনি ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ ছাড়াও তার মা শেখ রেহানা (Sheikh Rehana) এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তদন্তাধীন।
মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পেছনে চাপ?
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী টিউলিপ গত জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সরকারের ভেতর-বাহিরের চাপ, গণমাধ্যমে সমালোচনা এবং ঘনিয়ে আসা দুর্নীতির মামলার পটভূমিতে অনেকেই মনে করছেন—এই পদত্যাগ ছিল কৌশলগত।
তবে, টিউলিপ তার পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেননি। আর এবার দুদক চেয়ারম্যানের প্রশ্ন—“যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে পদ ছাড়লেন কেন?”—নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।