বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে গভীর সংকট দীর্ঘদিন ধরে জমে উঠেছে, তা এখন আর গোপন কিছু নয়। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন (Election Commission) ও বিচার বিভাগ (Judiciary)–এই দুটি প্রধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পতনীয় মানসিকতা আজ রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে যেসব ব্যক্তিরা অতীতে এসব অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, রাষ্ট্র রক্ষার জরুরি পূর্বশর্ত।
সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা (Nurul Huda) ও হাবিবুল আউয়াল (Habibul Awal)-এর গ্রেফতার নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি একটি বার্তা—যে কেউই দায়মুক্ত নয়। পাশাপাশি এটি নির্বাচনী কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগের বাস্তব রূপও প্রদর্শন করে।
তবে এই প্রয়াস এখনো অসম্পূর্ণ। কারণ, আজকের নির্বাচন ব্যবস্থার গভীর সংকটের মূলে যিনি ছিলেন, সেই সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক (Khaiurul Haque)-এর বিরুদ্ধে আজও কোনো জবাবদিহির উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২০১১ সালে তাঁর নেতৃত্বেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়—একটি সিদ্ধান্ত যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম অনাস্থা, সংঘাত ও নির্বাচনী প্রহসনের সূচনা করেছিল।
খায়রুল হকের বিতর্কিত রায় শুধু একটি নির্বাচনী পদ্ধতির পরিসমাপ্তি ঘটায়নি; এটি একটি প্রজন্মের গণতান্ত্রিক স্বপ্নকেই ছিন্নভিন্ন করেছে। এই রায়ের পরিণতিতে দেশে শুরু হয় একদলীয় শাসনের বাস্তবায়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে যায় এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অথচ এত বড় একটি ঐতিহাসিক বিভ্রান্তির মূল কারিগর হয়েও তিনি আজো অনাক্রম্য।
এখন প্রয়োজন এই আইনি দায়বদ্ধতার সূচনা। নির্বাচন কমিশনের শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থানেরও বিচার হওয়া জরুরি। খায়রুল হককে আইনের আওতায় এনে তাঁর সিদ্ধান্তের পরিণতি যাচাই করার মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে একটি নতুন জবাবদিহির ধারা। এটি প্রতিশোধ নয়; এটি ন্যায়বিচারের দাবি।
যদি বিচার বিভাগের শীর্ষস্থানে থেকেও কেউ গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলার লাইসেন্স পান, তবে তা শুধু বর্তমান নয়—ভবিষ্যতের জন্যও ভয়ানক সংকেত। আমরা চাই, বিচারপতির আসনে যারা বসেন, তারা যেন উপলব্ধি করেন যে এই পদ কোনো ব্যক্তিগত ক্ষমতা নয়—এটি জনগণের সঙ্গে করা একটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে জবাবদিহি হবে, বিচার হবে।
সেই জবাবদিহির শুরু হোক খায়রুল হকের গ্রেফতার দিয়ে। তাঁর বিচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে একটি দৃষ্টান্ত, যে কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। এই প্রক্রিয়াই ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত করতে পারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা। এবং তখনই আমরা এক সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যেতে পারি—যেখানে সংবিধান শুধু বইয়ের পাতা নয়, রাষ্ট্রের জীবন্ত চুক্তিপত্র।