বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক বাস্তবতায় এক শব্দ যেন দিনকে দিন অধিকতর পরিচিত হয়ে উঠছে—‘মব কালচার’ (Mob Culture)। বিচারের আশায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দ্বারে না গিয়ে জনতা নিজেরাই যখন রাস্তায় ‘বিচারক’ হয়ে ওঠে, তখন তা শুধু আইনভঙ্গ নয়—এ এক চরম আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। প্রশ্ন হলো, এই অস্থিরতা কি নিছক উন্মত্ত জনতার দোষ? নাকি এটি রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া?
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ফাটল থেকেই শুরু
ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও সুশাসন—এই তিন ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো একটি রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্বগুলো পালনে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের মধ্যে একটি ক্ষোভ জমতে বাধ্য। যখন নির্বাচন কমিশন (Election Commission) নিরপেক্ষতার বদলে পক্ষপাতিত্বে জড়িয়ে পড়ে, যখন বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের শাস্তির পরিবর্তে প্রশ্রয় দেয়, তখন মানুষ ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়।
এই বিশ্বাসচ্যুতি থেকেই জন্ম নেয় বিকল্প প্রতিক্রিয়া। জনতা মনে করে, আইনের দ্বারে ন্যায় নেই—বরং হাতের মুঠোতেই বিচার। এভাবেই গড়ে ওঠে মব কালচার, যেটি প্রথমে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও সময়ের সঙ্গে একটি ‘সামাজিক অভ্যাসে’ পরিণত হয়।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই যখন সহিংসতার উত্স
জনগণের আচরণকে দোষ দিয়ে থেমে যাওয়া যেমন অদূরদর্শী, তেমনি তা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার একটি পথও বটে। কেন মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে? প্রশ্নটা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। একজন সাধারণ নাগরিক কেন ভেবে নিচ্ছেন যে, অপরাধ করলে ক্ষমতাধর ব্যক্তি পার পেয়ে যাবে?
এই অনুভূতির পেছনে দায়ী সেই রাষ্ট্র, যে কিনা দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করে, অভিযুক্তদের পুরস্কৃত করে, এবং অভিযোগকারীকেই হয়রানি করে। যখন মানুষের কাছে রাষ্ট্র মানে হয় বৈষম্য, অবিচার আর অনিরাপত্তা—তখন মানুষ আর রাষ্ট্রের হাতে নিজের ভাগ্য সঁপে দিতে চায় না।
প্রতিকারের একমাত্র পথ: কার্যকর জবাবদিহি
মব কালচার দমন করতে চাইলেই কঠোর আইন প্রয়োগ করলেই চলবে না। এটি প্রতিরোধ করতে হলে রাষ্ট্রকে মানুষের বিশ্বাস ফিরে পেতে হবে। এর একমাত্র উপায়—একটি স্বচ্ছ, শক্তিশালী ও কার্যকর জবাবদিহিমূলক কাঠামো (Accountability Structure) গড়ে তোলা।
যারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকেও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা দমন-পীড়ন করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ। শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে যেন জনগণ উপলব্ধি করতে পারে—রাষ্ট্র আছে, এবং সে কাজ করছে।
উপসংহারে: সমস্যা নয়, উপসর্গ
মব কালচার নিজে কোনো ‘মূল সমস্যা’ নয়। এটি একটি উপসর্গ—একটি রুগ্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষণ। যখন আইন ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, যখন রাষ্ট্র নিজেই মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখনই মানুষ বিকল্প পথ খোঁজে—যেটি প্রায়শই হয় অনিয়ন্ত্রিত এবং সহিংস।
তাই, যদি আমরা সত্যিই সমাজকে মব কালচার থেকে মুক্ত করতে চাই, তাহলে শুরু করতে হবে আত্মসমালোচনা দিয়ে—রাষ্ট্রকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, তার দায় কোথায়? আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে সাহসিকতার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং—সবচেয়ে বড় কথা—জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের সঙ্গে।
ডাঃ ফেরদৌস কবির
সম্পাদক: তাজাখবর.কম