জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ধীরগতি ও মতানৈক্য, বাড়ছে হতাশা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) (National Constitutional Council), প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, উচ্চকক্ষ গঠন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য এলেও মৌলিক সংস্কারগুলোতে দলগুলোর ভিন্নমত কাটছে না।

এনসিসি নিয়ে প্রধান বিরোধিতা বিএনপির

বিএনপি (BNP) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এনসিসি কিংবা ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ গঠন—উভয় প্রস্তাবেই তারা একমত নয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারকে দুর্বল করতে নয়, বরং আইন সংস্কার করে স্বচ্ছ সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ ব্যবস্থা করতে হবে। তারা মনে করে, এনসিসি গঠনের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কার্টেল করা হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।

দ্বিতীয় দফার আলোচনায় অগ্রগতি কম

দ্বিতীয় দফার আলোচনার ষষ্ঠ দিনে অংশ নিয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এতে ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এবং কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলের হাতে দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এছাড়া নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতিসহ ৯টি বিষয়ের ওপর আলোচনা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ঐকমত্য তৈরি হয়নি।

কমিশনের প্রস্তাব ও প্রতিক্রিয়া

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission) জানিয়েছে, সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ সভায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকারসহ বিভিন্ন প্রতিনিধিরা। তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির নাম এ কাঠামো থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট হামিদুর রহমান আজাদ এবং এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানিয়েছেন, এনসিসি গঠনে তারা নীতিগতভাবে একমত হলেও গঠন কাঠামো নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।

গণঅধিকার পরিষদের (Gonodhikar Parishad) সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, কিছু দল অনড় অবস্থানে থাকায় ঐকমত্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। তার মতে, যদি এভাবে চলতে থাকে, তবে ‘কেয়ামত পর্যন্ত ঐক্য হবে না।’

‘জুলাই সনদ’ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়

এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, সব বিষয়ে ঐকমত্য সম্ভব না হলেও যেগুলোতে সম্মতি আছে, সেগুলো নিয়েই ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করা হবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির (Revolutionary Workers Party) সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব এবং নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।

তিনি শর্তসাপেক্ষে এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দেন, তবে সশস্ত্র বাহিনী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো বিষয়গুলো এনসিসির বাইরে রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতিকে এই কমিটি থেকে বাদ রাখার পক্ষেও মত দেন তিনি।

দ্বিকক্ষ সংসদ ও অন্যান্য ইস্যু

সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে অনেক দল একমত হলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে রয়েছে বিভক্তি। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Citizen Party) তালিকা প্রকাশের পক্ষে, বিএনপি চায় নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ বরাদ্দ। জামায়াতে ইসলামী চাইছে উভয় কক্ষে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি।

নারী আসনে সরাসরি ভোট, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ ও সংবিধানের মূলনীতি নিয়েও রয়েছে মতানৈক্য। বিশেষত বামপন্থী দল ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো এখানে বিপরীত অবস্থানে।

আশাবাদী হলেও হতাশা বাড়ছে

আলোচনা দীর্ঘ হলেও কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মত দেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, “তিন দিন ধরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না।”

অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “দলগুলোর নমনীয় মনোভাব রয়েছে, যা ইতিবাচক। আশা করছি, জাতীয় স্বার্থে কিছু ছাড় দিয়ে শিগগিরই একাধিক বিষয়ে ঐকমত্য সম্ভব হবে।”

ভবিষ্যৎ করণীয়

কমিশন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৯টি বিষয়ে আলোচনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও প্রায় ২০টি বিষয়ের ওপর আলোচনা করার পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে থাকবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, নির্বাচন সীমানা নির্ধারণ, স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল ইত্যাদি।

জুলাইয়ের মধ্যে ‘জাতীয় সনদ’ প্রস্তুত করার লক্ষ্যে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। যদিও এখনও অনেকগুলো বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য না হওয়ায় গণভোট, গণপরিষদ ও নির্বাহী প্রজ্ঞাপন—এই তিন বিকল্প প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *