বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ইতি টানলেন উমামা ফাতেমা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যাত্রার অবসান ঘটালেন সংগঠনের পরিচিত মুখ, নেত্রী উমামা ফাতেমা (Umama Fatema)। ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া একটি দীর্ঘ আবেগময় স্ট্যাটাসে তিনি তার অভিজ্ঞতা, ক্ষোভ এবং হতাশার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে একটি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে থাকা কুৎসিত রাজনীতির কাহিনি, অভ্যন্তরীণ কলহ, ষড়যন্ত্র এবং অব্যবস্থাপনার চিত্র।

উমামা জানান, গত পরশু অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে এই মঞ্চের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। তার ভাষায়, এনসিপি নামক একটি রাজনৈতিক দলের গঠনের পর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে এই ব্যানারে যুক্ত হলেও, স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে—এবং সেখান থেকেই তার উপর শুরু হয় “ভয়াবহ” চাপ।

“এই ব্যানার নিয়ে কাজ করাটা যেন অনেকের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল,” লেখেন উমামা। নিজের আত্মবিশ্বাস এবং ইতিবাচক উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ব্যানার সচল রাখার চেষ্টা করলেও, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সুযোগসন্ধানী রাজনীতি এবং অব্যাহত Character Assassination-এর কারণে তাকে বারবার হোঁচট খেতে হয়।

“যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিল করেছি, তারাই জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে smear campaign চালিয়েছে”—উমামার কথায় ফুটে ওঠে একধরনের ছেঁড়া ছেঁড়া বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা। তিনি বলেন, এই প্ল্যাটফর্মের অনেক জেলা-উপজেলা কমিটি ইতোমধ্যে সুবিধাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যদিও কিছু “goodwill” সম্পন্ন ছাত্র ছাত্রী চেষ্টা করেছেন ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে, তবে তারা রাজনীতির দমবন্ধ পরিস্থিতিতে সরে পড়েছেন।

উমামা নিজের মানসিক বিপর্যয়ের কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন। মার্চ-এপ্রিল মাসে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ভেঙে পড়েন। বৈষম্যবিরোধীর ফেসবুক পেইজ থেকেও তার বিরুদ্ধে পোস্ট করা হয়, অথচ তিনি ছিলেন সেই প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র। এরপরও যখন নিজের বক্তব্য প্রকাশে তিনি আগ্রহী হন, তখন তাকে “Silent Treatment” দেয়া হয়।

তিনি অভিযোগ করেন, প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চাইলেও পেছনে বলা হতো, “উমামা কাউকে কাজ করতে দিচ্ছে না, কাউন্সিল আটকে রেখেছে।” অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল না তার হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেয়ার রোডের একটি অংশবিশেষ নেতৃত্ব নেয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যেখানে রাতের আঁধারে পদ-পদবী নিয়ে ‘বার্গেইনিং’ চলেছে বলে তিনি দাবি করেন।

এক পর্যায়ে, কাউন্সিল ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজের বিবেকের তাড়নায় তিনি ভোট দেন। “আমি ভিতর থেকে চাইছিলাম প্ল্যাটফর্মটা অন্তত কিছু ভালো করুক”—উমামার এই কথায় প্রতীয়মান হয় এখনো কিছুটা আশা তার অন্তরে ছিল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলে এমন এক ব্যক্তি সদস্য নির্বাচিত হন যিনি এই নির্বাচনে প্রার্থীই ছিলেন না। এমন ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ দেখে তিনি চূড়ান্তভাবে হতাশ হন এবং কাউন্সিল থেকে নিজের ভোট ও সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

উমামা বলেন, এই আন্দোলনের আড়ালে গোষ্ঠীস্বার্থ, ভাই-ব্রাদার সিন্ডিকেট এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার যে কদর্য চিত্র তিনি দেখেছেন, তাতে তার রাজনৈতিক আদর্শিকতা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, যারা তাকে দীর্ঘদিন ধরে নোংরা রাজনীতির শিকার বানিয়েছে, অভ্যুত্থানকে বাজারে বিক্রির মতো ব্যবহার করেছে—তাদের তিনি “রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া” দিচ্ছেন।

“আমি তো মানুষ, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে তো আসিনি”—এই একটিমাত্র বাক্যে উমামা যেন তার পুরোটাই সংক্ষেপে প্রকাশ করেছেন।

তবে, শেষ পর্যন্ত উমামা নিজের ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী। তিনি লেখেন, “আমি ভেঙে পড়ছি না, গুছিয়ে আনছি সবকিছু। ফি আমানিল্লাহ।”

তার এই দীর্ঘ স্ট্যাটাস শুধু এক ব্যক্তির প্ল্যাটফর্ম ত্যাগের ঘোষণা নয়—বরং এটি একটি আন্দোলনের ভেতরের গভীর সংকট ও রাজনৈতিক ছলনার বিরুদ্ধে এক সাহসী উচ্চারণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *