‘মামলাটা উঠাতে চাই, দেশ শান্তিতে রাখতে চাই’: মুরাদনগরের সেই নির্যাতিত নারীর আবেগঘন আবেদন

‘মামলাটা উঠাতে চাই, দেশ শান্তিতে রাখতে চাই’—এভাবেই নিজ অভিজ্ঞতার যন্ত্রণাময় বিবরণ দিয়ে হৃদয়বিদারক আবেদন জানালেন কুমিল্লার মুরাদনগরের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সেই নারী। রোববার (২৯ জুন) নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘হের (ফজর আলী) তো অবস্থা খারাপ। বাঁচে না মরে বলা যায় না। সে যদি এলাকায় হাঁটা-চলা করতো তাহলে মামলা করে কাজ হতো। এখন ওর মরার অবস্থা। আমরা মামলাটা উঠাতে চাই, দেশে শান্ততে রাখতে চাই। হিন্দু-মুসলমান শান্তিতে থাকুক।’

ভুক্তভোগী নারী জানান, ‘আমার মানসম্মান সব গেছে, সবাই মুক্তি পাক। আমি দুটি শিশুসন্তান নিয়ে বাঁচতে চাই। আমি দশজনের শান্তি চাই, দেশের শান্তি চাই। আমার যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। আমি মামলা তুলে নেব।’

তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো চাপ বা লোভের ইঙ্গিত নেই বলে তিনি স্পষ্ট করেন। তার ভাষায়, ‘আমি মামলা করেছি, আমি তুলে ফেলবো। আমি দশজনের ভালো চাই। মামলা তুলে নিতে আমাকে কেউ চাপ দেয়নি। টাকার লোভও দেখায়নি। আমার স্বামী বলেছে- “তোর সম্মান যা যাওয়ার গেছে। এখন কেস করলেও সেই সম্মান ফিরে পাবি না।”’

ঘটনার পেছনের জটিল পারিবারিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন তিনি। জানান, তার মা ফজর আলীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই পাওনা টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে ফজর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ হতো। কিন্তু ফজরের ছোট ভাই বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখে সন্দেহ করে। এমনকি এক পর্যায়ে ওই ভাই ঘরে ঢুকে তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে তা ভেঙে ফেলে। পরে গ্রাম্য সালিশে ওই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়।

নৃশংস ঘটনার দিন অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার রাতে কী ঘটেছিল, তা বর্ণনা করতে গিয়ে ভুক্তভোগী বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে ফজর আলী আমাদের ঘরের সামনে এসে দরজা খুলতে বলেন। আমি বলেছি, আমার বাবা-মা পাশের বাড়ির সাপ্তাহিক পূজায় গেছে। আমি আর দুই সন্তান ঘরে। এই সময় তিনি কৌশলে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করেন এবং আমার ওপর অত্যাচার করেন। কিছুক্ষণ পর ৭-৮ জন এসে ফজর আলীকে মারধর করে। তাকে মারার পর আমাকেও মারধর শুরু করে। তারা আমার ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়।’

ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শনিবার ফেসবুকে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি সবার নজরে আসে।

শুক্রবার ধর্ষণের অভিযোগে ফজর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন নির্যাতিতা নারী। মামলার পরপরই পুলিশ অভিযুক্ত ফজর আলীসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত চারজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। রোববার মুরাদনগর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় চারজনের নাম উল্লেখসহ আরও ২০–২৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

ভিডিও ছড়ানোয় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন—আবদুল হান্নানের ছেলে মো. আলী সুমন, জাফর আলীর ছেলে রমজান, মো. আলমের ছেলে আরিফ এবং তালেম হোসেনের ছেলে অনিক। চারজনকেই আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এদিকে অভিযুক্ত ফজর আলী বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশ জানায়, চিকিৎসার ছাড়পত্র পেলে তাকেও আদালতে তোলা হবে।

ঘটনার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান (Nazir Ahmed Khan)। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *