নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত এক পরিচিতি সভায় ‘জুলাই আন্দোলন’ বিরোধী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
শনিবার (২৯ জুন) দুপুরে উপজেলার বিজয় চত্বরে অনুষ্ঠিত এই পরিচিতি সভায় স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম। অনুষ্ঠানের ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ক্ষোভ ও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে।
জাহাঙ্গীর আলম সম্পর্কে জানা যায়, তিনি সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার (Aftab Uddin Sarkar)-এর ভাগ্নে এবং তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে দমন করার অভিযোগ বহু পুরনো। ২০১৮ সালের ইউপি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-র প্রার্থী অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেনের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একইভাবে বিএনপি-সমর্থিত রবিউল ইসলাম লিথনের নির্বাচনী কার্যক্রমে হামলা ও হয়রানির ঘটনাও ব্যাপক আলোচিত।
২০২৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীর জয়লাভ করলেও ভোটকেন্দ্র দখল ও সহিংসতার অভিযোগে তিনি একাধিক মামলার আসামি হন। পরের বছর ‘জুলাই আন্দোলন’ (July Movement) চলাকালে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও পুলিশি হয়রানির পেছনে তার নেতৃত্বের অভিযোগ উঠে আসে।
এই পটভূমিতে এনসিপির মঞ্চে জাহাঙ্গীরের উপস্থিতি অনেকের চোখে ‘আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উপজেলা পর্যায়ের এক সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই লোক আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এখন তাকে মঞ্চে দেখে মনে হয়েছে যেন আমাদের সংগ্রামের মূল্যই হারিয়ে গেল।”
এই অবস্থান থেকে ব্যতিক্রম কিছু মন্তব্যও রয়েছে। এনসিপির নীলফামারী জেলা কমিটির সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক রাশেদুজ্জামান রাশেদ (Rasheduzzaman Rashed) জানান, “জাহাঙ্গীর ২০২৩ সালের পর আওয়ামী লীগের সকল পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। আমি শুনেছি, তিনি নাকি ২০২৪ সালের আন্দোলনে সহযোগিতা করেছেন—সে কারণেই তাকে নেওয়া হয়েছে।”
তবে এই তথ্যের যথার্থতা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় তার দ্বারা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, যারা অতীতে দমন-পীড়নের অংশ ছিলেন, তারাই আজ বিকল্প রাজনীতির মঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছেন—এটি রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। একজন মন্তব্য করেছেন, “ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন মানেই আন্দোলনের শহীদদের রক্তের প্রতি অবমাননা।”
উল্লেখযোগ্য যে, এনসিপির ডিমলা কমিটিতে মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় পার্টির নেতা মোশারফ হোসেন মিন্টু (Mosharaf Hossain Mintu)। কমিটিতে আরও রয়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ন্যাপ নেতা জাকারিয়া হোসেন রাজু (Jakaria Hossain Raju), আওয়ামী লীগ কর্মী রবিউল ইসলাম শুকারু এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত হাফেজ সুজন ইসলাম (Sujon Islam)।
তবে সমালোচনার মুখে জাকারিয়া হোসেন রাজু ফেসবুকে তার অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, “আমি বাংলাদেশ ন্যাপ-এর ডিমলা উপজেলা সভাপতি ছিলাম, আছি এবং থাকব। বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াবেন না।” অন্যদিকে, হাফেজ সুজন ইসলামও ফেসবুকে লেখেন, “আমি জুলাই আন্দোলনে ছিলাম। এখন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছি এবং থাকব।”
এই বৈপরীত্য ও আদর্শগত জটিলতার মধ্যে এনসিপির পরিচিতি সভা ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—বিকল্প রাজনীতি কি আদর্শভিত্তিক নাকি পুরনো চরিত্রের পুনর্বাসনের নতুন মোড়ক?