নারায়ণগঞ্জে দেশের প্রথম ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের স্মৃতিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হলো। সোমবার বিকেলে হাজীগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টা একযোগে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। তারা জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের স্মরণে এ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এবং এ সরকারের মেয়াদকালেই সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হবে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল (Asif Nazrul) বলেন, “জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার অনেকদূর এগিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া চলমান এবং নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার মামলার চার্জশিট ৫ আগস্টের মধ্যে জমা দেওয়া হবে। এরপর তা দ্রুত বিচার আইনে নিষ্পত্তির বিষয়টি বিবেচনায় আনা হবে।”
তিনি আরও বলেন, চাঁদাবাজি, খুন ও সন্ত্রাস এখনো দেশের নানা জায়গায় বাড়ছে, তবে এসব রুখে দিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শহীদ পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সায়েদা রিজওয়ানা হাসান (Syeda Rizwana Hasan) বলেন, “৩৬ দিনের আন্দোলনে যে ছাত্র–জনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তারা দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে। এই স্মৃতিস্তম্ভ তাদের আত্মত্যাগের স্থায়ী স্বীকৃতি।” তিনি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের আহ্বান জানান।
শিল্প ও গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান (Adilur Rahman) স্মরণ করিয়ে দেন, সাড়ে ১৫ বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়। “এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সত্য তুলে ধরতেই গণভবনকে ‘ফ্যাসিস্ট জাদুঘর’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে,” বলেন তিনি। সেখানে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের নিদর্শন সংরক্ষণেরও ঘোষণা দেন।
অনুষ্ঠানে এক আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন শহীদ আদিলের মা মঞ্চে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, “আমার ছেলে বেঁচে থাকলে এবারের এসএসসি দিত। কিছুদিন আগে রেজাল্ট হয়েছে, সে থাকলে মাকে রেজাল্ট দেখাতে আসত। ফ্যাসিস্টদের গুলিতে আমার ছেলে নিহত হয়েছে। আমি বিচার চাই।” তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় হাজারো মায়ের শোক ও প্রতিশোধের আকুতি।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় নারায়ণগঞ্জে ৫৬ জন প্রাণ হারান, আহত হন ৩৭০ জন। নিহতদের মধ্যে ২১ জন ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই শহীদদের স্মরণে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (Chowdhury Rafiqul Abrar), জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান (Fauzul Kabir Khan), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেছুর রহমান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফুদ্দিন চৌধুরী, জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা ও পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার (Pratyush Kumar Majumder)। শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহতরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টারা স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধনের পর পরিবেশ সচেতনতায় গাছের চারা রোপণ করেন।