বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “একাত্তরের চেতনা যেমন বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য, তেমনি যেন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা নিয়েও একই ধরনের চেতনা-ব্যবসা না হয়।
রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল: অভ্যুত্থানের অজানা অধ্যায়’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নির্মোহ ইতিহাস লেখার এখনই সময়। জানিনা এই অভ্যুত্থান নিয়ে কত ইতিহাস হবে, কত কাব্য হবে, উপন্যাস হবে, নাটক হবে, কত স্মৃতিচারণ হবে, কত পদ্য রচনা হবে। তবে গণ অভ্যুত্থানের উপাখ্যান নিয়ে লেখা কখনো শেষ হবে না। তবে আমি অনুধাবন করি, একাত্তরের চেতনা ব্যবসার মতো চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান নিয়েও যেন কোনো চেতনা ব্যবসা না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। আমি তাদেরকে নসিহত করি, যারা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের একমাত্র ভাগীদার হিসেবে নিজেদের দাবি করতে চায়- তারা যেন উপলব্ধি করে, একটা গণঅভ্যুত্থান সারাদেশের আপামর জনতার অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত হয় না।”
তিনি বলেন, “বিগত ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-ছাত্রীদের স্লোগানে ১৫ জুলাই যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল, তা শহীদ আবু সাঈদ ও ওয়াসিম মুগ্ধর জীবন দানের মধ্য দিয়ে দাবানলে পরিণত হয়। অভ্যুত্থানের সেই শহীদরাই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপান্তর করে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেই দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়েছে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্টদের মসনদ। সবাইকে নিয়ে অতঃপর আমরা বিজয় অর্জন করেছি।”
তিনি বলেন, “আমি পঙ্গু হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে দেখেছি তারা কীভাবে জীবন নিয়ে সংগ্রাম করছে। আগামী বাংলাদেশ হবে আহতদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। তারা যেভাবে চায়, সেভাবেই গঠিত হবে আগামীর নতুন বাংলাদেশ। শহীদদের স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি মানবিক মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেই সাম্যের বাংলাদেশ আমাদের বিনির্মাণ করতে হবে একসাথে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল শক্তিকে জাতীয় ঐক্যতে পরিণত করতে হবে। এই কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।”
বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আজকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে কারা বিভেদ তৈরি করছে? অথচ আমরা গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ পরস্পর লড়াই করছি আর আরামে আছে দিল্লিওয়ালারা। আমাদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ এবং লড়াই, তারাই উপকৃত হবে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই আমরা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ত্যাগ-তিতিক্ষা-লড়াইকে ভুলে যাচ্ছি। আমরা পরস্পরকে মর্যাদাবান করার পরিবর্তে অপমানিত করার সুযোগ নিচ্ছি। কেন জানিনা আমাদের মধ্যে ইদানীং সে চর্চাটা শুরু হয়ে গেছে।”
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি রাষ্ট্রের আরক্ষিক স্বাধীনতা- তথা সেনাবাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অর্থনীতিকে রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে একটি শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আজ যারা দেশপ্রেমের কথা বলে, তারা জিয়ার আত্মত্যাগের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অন্যতম রূপকার। আজ যখন গণতন্ত্র হুমকির মুখে, তখন শহীদ জিয়ার আদর্শই পারে জাতিকে নতুন করে পথ দেখাতে।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আলহাজ্ব রকিবুল ইসলাম বকুল। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, ড. মাহদী আমিন, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান এবং বাসস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মোর্শেদ। বইটি প্রকাশ করেছে আদর্শ প্রকাশনী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রকাশক মাহাবুব রহমান। সভাপতিত্ব করেন গ্রন্থের লেখক ও ঢাবি ছাত্রদল নেতা আবিদুল ইসলাম খান।
আলোচনা সভায় বিএনপি ঘরানার বহু শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিতি ছিলেন। বক্তারা বইটিকে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মূল্যবান প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এসব উল্লেখ করেন।
গ্রন্থের লেখক আবিদুল ইসলাম খান বলেন, “২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছিল এক অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণ, যা দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালি তরুণদের ক্ষোভ, ত্যাগ ও সংগ্রামের ফসল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটি আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ দাবিকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনের সূচনা, তা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিণত হয় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে।”
তিনি আরও বলেন, “এই গ্রন্থ সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলে রূপান্তরের পেছনের গল্প বলার এক বিনীত প্রচেষ্টা। এখানে শুধু রাজপথের সংগ্রামের চিত্রই নয়, বরং প্রতিটি কর্মসূচির পেছনের কৌশল, সংকটকালে নেওয়া দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত এবং সাধারণ মানুষের একে অপরের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার উপাখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লেখক আবিদুল ইসলাম খান নিজেও ২৪-এর অভ্যুত্থানের একজন সম্মুখ সারির সংগঠক ছিলেন। তাঁর এই গ্রন্থে উঠে এসেছে আবু সাঈদ, ওয়াসিম মুগ্ধ, মুগ্ধ, জিল্লুর, আনাস, শাহরিকসহ শত শত শহিদের বীরত্বগাথা।