বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা দেখছি, কয়েকটি রাজনৈতিক দল দেশে হঠাৎ করেই পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই পদ্ধতির নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের অর্থ রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ, ফ্যাসিবাদ, চরমপন্থার পথ সুগম করে দেবে। এতে বিভ্রান্তিমূলক সমাজ সৃষ্টি ও সরকার অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে উঠবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে।’
সোমবার (২১ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পেশাজীবীদের অবদান নিয়ে পেশাজীবী সমাবেশ এবং শহীদ-নির্যাতিত পরিবারকে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি)।
তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের জনগণের ঐক্য চাইলে কোনোভাবেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত না। এই ধরনের দাবিকে কোনো দল গণতান্ত্রিক অধিকার বিবেচনা করলেও দেশ ও জনগণের স্বার্থে উপযোগী নয় বলেই আমরা মনে করি। কারণ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেই কিন্তু সেটি প্রমাণিত হয়েছে।’
পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দেশে চরমপন্থার পথ সুগম করবে : তারেক রহমান
একটি গোষ্ঠী বিএনপি ও তারেক রহমানকে টার্গেট করেছে : রিজভী
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশকে তাঁবেদার ও ফ্যাসিবাদমুক্ত রাখতে সবচেয়ে জরুরি জনগণের ঐক্য।’
তারেক রহমান বলেন, ‘সংবিধিবদ্ধ বিধি-বিধান আর আইনকানুন দিয়ে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে আটকানো যায় না। আইন না মানার কারণেই কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য জনগণকে যে কোনো মূল্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রে তাদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক চর্চা যদি থাকে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার মোকাবিলায় জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই কিন্তু যথেষ্ট। বিএনপি কিন্তু প্রথম থেকেই জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কথা বলছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের খবরদারি বহাল রাখতে চায়। কিংবা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্নভাবে ফায়দা হাসিল বা নিজেদের আখের গোছাতে চায়। কিন্তু তাদেরই আমরা দেখছি যে, সুকৌশলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাধার সৃষ্টি করছে। এই কথা বিভিন্ন জায়গা থেকে সামনে আসছে।’
বক্তব্যের শুরুতেই রাজধানীর উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের খবরে গভীর শোক প্রকাশ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের সহায়তার জন্য বলা হয়েছে। চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবসহ অন্যদেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদলের নেতাদের নিয়ে টিম গঠন করা হয়েছে। আমাদের কর্মীদের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের অবস্থান থেকে আমরা চেষ্টা করছি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে তারেক রহমান বলেন, ‘দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে জনগণের কাঁধে একটি ফ্যাসিবাদী অপশাসন চেপে বসেছিল। এই শাসনকে সরানোর জন্য শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, কর্মজীবী, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক, সিএনজিচালিত অটোচালক, ট্রাকের হেলপার বা চালকসহ খেটে খাওয়া সর্বস্তরের মানুষ স্বৈরাচার হটাতে রাজপথে নেমে এসেছিল। অনেকের মনে আছে, চট্টগ্রামের ফার্নিচার কর্মী শহীদ ফারুক, ঢাকার আশুলিয়ায় গার্মেন্টস কর্মী নাজমুল, চাঁদপুরের সেলসম্যান আব্দুল কাদের মানিক, সাংবাদিক মেহেদী হাসান, শরীয়তপুরের ব্যাংক কর্মকর্তা দুলাল আহমেদ, নরসিংদীর ডা. সজীব সরকার, গাইবান্ধার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদ হোসেন সজলসহ সারা দেশের অসংখ্য শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছেন দেশকে মুক্ত করার জন্য। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, জুলাই আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করার ব্যাপারে শ্রমজীবী-কর্মজীবী ও পেশাজীবী মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। তারাই বেশি শহীদ হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র শহীদ ওয়াসিমসহ ৬ জন শহীদ হয়েছিলেন। সেদিন থেকেই মূলত আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। ওই ৬ শহীদের অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রামের ফার্নিচার কর্মী শহীদ ফারুক। তার বিধবা স্ত্রী ও নিষ্পাপ কন্যার একটি বক্তব্য ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে যে, ফারুকের কথা কেউ বলে না। কারণ তার স্বামী ছাত্র ছিলেন না। আমি মনে করি, শহীদ ফারুকের স্ত্রীর এই কথার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের প্রচলিত প্রথাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘শহীদরা শুধু একটি সংখ্যা নয়। একটি প্রাণের সমাপ্তির অর্থ হলো, একটি পরিবারের মৃত্যু। একটি স্বপ্ন-সম্ভাবনার অবসান। অথচ আমরা দেখছি, আজকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যেকটি শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা (সরকার) রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কার নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করছেন, মিটিং করছেন। কিন্তু খুব দুঃখজনক যে, এক বছর হতে চললেও সরকারের পক্ষে শহীদদের তালিকাটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটি করতে না পারলে ভবিষ্যতের ইতিহাসে আমাদের সবার জন্য ব্যর্থতা হিসেবে চিত্রায়িত হবে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা অনেককেই দেখি অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্নভাবে খুবই তৎপর। কিন্তু শহীদদের তালিকা তৈরির ব্যাপারে এই তৎপরতা থাকলে নিশ্চয়ই এতদিনে শহীদদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে পারতাম।’
অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘কিছু কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয় থাকা উচিত। কেননা, সরকারের রাষ্ট্র মেরামতের তালিকায় নিত্যনতুন বিষয় সংযুক্ত হলে বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিতে পারে। শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বিস্মিত করেছে। এক বছরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরানো সম্ভব হয়নি। ক্যাম্পাসগুলোকে অন্ধকারে রেখে পুথিগত সংস্কার দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ আলোকিত গড়া সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন তৈরি হয়।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কিন্তু কারও একক অবদান নয়। গণঅভ্যুত্থানে সবার অবদান রয়েছে। মানুষ অধিকার আদায়ের জন্যই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন, জীবন দিয়েছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিদিন নতুন নতুন দাবি আসছে। কিন্তু আমরা এসব ডামাডোলের মধ্যেই যেন শহীদদের ভুলে না যাই। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে যারা রাষ্ট্র ও সরকারে প্রভাব বজায় রাখতে নানারকম অপকৌশল করছেন, তাদের আহ্বান জানাই, দয়া করে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না।’
তারেক রহমান আরও বলেন, ‘শাসক বদলেছে, কিন্তু শাসনের চরিত্র বদলায়নি। জনগণের এমন ধারণা সৃষ্টি হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কঠিন সংকট তৈরি হবে। এখন শহীদদের প্রতি ঋণ পরিশোধের পালা। একাত্তর সালের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে শহীদ ও ২৪ সালে স্বাধীনতা রক্ষার শহীদ কিংবা অন্যান্য সময়ে দেশের জন্য শহীদদের প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা। জনগণের রায়ে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান শহীদদের নামে করার চিন্তা আমাদের রয়েছে।’
বিএসপিপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব কাদের গণি চৌধুরী এবং ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের যৌথ পরিচালনায় বক্তব্য দেন বিগত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন পেশায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু, নূরুল ইসলাম মনি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, মিজানুর রহমান মিনু, ইসমাইল জবিহউল্লাহ, এমএ মালিক, যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদ, পেশাজীবীদের মধ্যে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) ভিসি অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ ড. আবুল হাসনাত মো. শামীম, রুয়েটের ভিসি অধ্যাপক এসএম আবদুর রাজ্জাক, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এসএম সোহাগ আউয়াল, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আখতার হোসেন খান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক লুৎফর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম, প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল, প্রকৌশলী মো. মোস্তফা-ই জামান সেলিম, অধ্যক্ষ সেলিম ভুইয়া, অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদ, সাংবাদিক কামাল উদ্দিন সবুজ, এমএ আজিজসহ ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী ও সারা দেশের বিভিন্ন পেশার সহস্রাধিক প্রতিনিধি।
উল্লেখ্য, উত্তরায় প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কারণে অনুষ্ঠানটি দ্রুত শেষ করা হয়।