সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (ABM Khairul Haque)–কে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল আটটার কিছু পর তার ধানমন্ডির বাসা থেকে তাকে আটক করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম (Mohammad Nasirul Islam)।
“সকাল আটটার একটু পর আমরা তাকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করি। বর্তমানে তাকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে,”—বলেন ডিবির শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০১১ সালের ১৭ মে ৬৭ বছর পূর্ণ হলে তিনি অবসর নেন। তবে তার বিচারকালীন সময় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও রায় নিয়ে তৈরি হয় ঘনীভূত বিতর্কের ঘূর্ণিপাক।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অভিযোগ
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম (Nationalist Lawyers’ Forum) এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দাবি তোলে—খায়রুল হক ছিলেন দেশের “বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর”। তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানায় সংগঠনটি।
এই দাবির রেশ ধরেই অবশেষে আজকের এই গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল বলে অনেকেই মনে করছেন।
আলোচিত রায় ও বিতর্কের ইতিহাস
খায়রুল হককে ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক শুরু হয় ২০১১ সালে, যখন তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এই রায়কে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা বলে মনে করে অনেকে। ওই রায়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারকে অনির্বাচিতভাবে ভোট ডাকাতির সুযোগ করে দেওয়া হয় বলে সমালোচনা উঠে।
তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে। একাধিক জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে উপেক্ষা করে খায়রুল হককে ওই পদে বসানো হয়েছিল, যা বিচার বিভাগে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলে।
এছাড়া বিতর্কিতভাবে ত্রাণ তহবিল থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য টাকা নেওয়া, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর রায়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (Ziaur Rahman)–কে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি না দেওয়া এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নির্দেশ—এসব মিলিয়ে তিনি বিচারাঙ্গনের এক চরম বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত হন।
মামলার পরিণতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা ইতোমধ্যেই হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ দিন পর ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবর্তন’ করার অভিযোগ আনা হয়।
সরকার পতনের পরের ঘটনা প্রবাহেও খায়রুল হক আলোচনায় আসেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষদিকে আইন কমিশনের (Law Commission) চেয়ারম্যান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর, ১৩ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। আজকের গ্রেপ্তার সেই আত্মগোপনের পরিসমাপ্তি টানল।
দেশের বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এবিএম খায়রুল হকের গ্রেপ্তার নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে থাকবে।