পেছনে হাতকড়া পড়ানো বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অন্য রকম আদালত ভ্রমণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হলো। বৃহস্পতিবার রাতে এ বি এম খায়রুল হক (ABM Khairul Haque)-কে ঢাকার সিএমএম আদালতে আনা হয় যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায়। আদালতের কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা খায়রুল হকের চেহারায় ফুটে উঠেছিল অভূতপূর্ব এক বিচারের বিষণ্নতা। যে আদালতে বিচারপতির এজলাশকে ব্যবহার করে হাসিনার মসদনকে পাকাপোক্ত করেছিল , কলংকিত করছিল পুরো বিচার ব্যবস্থাকে, সেই আদালতেই আজ তাকে আসতে হয়েছে পিছনে হাতকড়া পড়া অবস্থায়।

রাত ঠিক ৮টা। একটি নীল প্রিজন ভ্যান ঢুকে পড়ে পুরান ঢাকার সিএমএম আদালতের প্রাঙ্গণে। ভেতরে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তাঁকে দেখতে পেয়ে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা—তাঁদের দাবি, এই বিচারপতির ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কার্যকলাপের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।

প্রিজন ভ্যান সরাসরি হাজতখানায় ঢুকে পড়ে। এরপর শুরু হয় নিরাপত্তা টানটান এক মুহূর্ত। পুলিশ কর্মকর্তা তারেক জুবায়েরের নেতৃত্বে কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়, আদালতের প্রতিটি প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও তখন আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন।

অবশেষে পিছনে হাতকড়া পরা অবস্থায় হাজতখানা থেকে বের করা হয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে। পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল—এই অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে পুলিশ সদস্যদের বাহু ধরে তিনতলা আদালতের সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন।

আদালতে তখন অপেক্ষা করছিলেন শতাধিক বিএনপি-ঘনিষ্ঠ আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। বিচারপতির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক প্রধান বিচারপতির হাতকড়া এক পর্যায়ে খুলে দেওয়া হয়, কিন্তু ডান হাতে সেটি ঝুলে থাকে। তাঁর চোখেমুখে তখনো হতাশা ও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

আদালতের এজলাসে তখন শুরু হয় অভিযোগের সুনামি। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা খোরশেদ আলম আদালতকে বলেন, “এই ব্যক্তি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে বিচার বিভাগের অপব্যবহার করেছেন। শেখ হাসিনাকে স্বৈরশাসকে পরিণত করার মূল কারিগর এই বিচারপতি। উনি আওয়ামী লীগের একজন কর্মীর মতো আচরণ করেছেন।”

আরেক নেতা বলেন, “দেশের শত শত মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। এসব অপকর্মে মদত দিয়েছে বিচার বিভাগের ছায়া। খায়রুল হক সেই ছায়ার প্রতীক।”

রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক ও আবুল কালাম খান জানান, খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একাধিক থানায় রাষ্ট্রদ্রোহসহ জালিয়াতির মামলা রয়েছে। তাঁকে জামিন দিলে তদন্ত বিঘ্নিত হবে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে। আদালত তাই তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এ সময় আদালতে বিদ্যুৎ চলে গেলে পুরো এজলাস অন্ধকার হয়ে যায়। আইনজীবীরা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে এজলাস আলোকিত করেন। অন্ধকারেই সাবেক বিচারপতি কাঠগড়া থেকে পেছনে সরে যান, পুলিশ সদস্যরা তাঁকে ঘিরে রাখে।

আদালতের আদেশ শোনার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি আবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুলিশ সদস্যরা তাঁর হাতে পুনরায় হাতকড়া পরিয়ে দেন, মাথায় হেলমেট পরিয়ে তিনতলা থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনেন।

রাত ৯টায় তাঁকে আবার প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। প্রিজন ভ্যানটি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

এই ঘটনা শুধু একটি মামলার প্রক্রিয়া নয়—এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার এক যুগান্তকারী অধ্যায়। এক সময় যিনি ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারক, তিনি আজ কাঠগড়ায়, চোখেমুখে লজ্জা আর অনুশোচনা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *