বাংলাদেশে ‘জাতীয় ঐক্য’ কথাটি বহুবার উচ্চারিত হয়েছে, বিশেষত রাষ্ট্র যখন গভীর রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকটে পতিত হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এই শব্দটির গুরুত্ব যেন একেবারে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান (Zillur Rahman) বলছেন, এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়—বরং এটি সরকারের বৈধতা ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার একমাত্র হাতিয়ার।
সম্প্রতি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ‘জাতীয় ঐক্য নেই, নিরাপত্তাও নেই: মোহভঙ্গের পথে বাংলাদেশ | নির্বাচন অনিশ্চিত!’ শিরোনামের বিশ্লেষণে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যে গণঅভ্যুত্থান ঘটে, তাতে শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)-র দীর্ঘ একচেটিয়া শাসনের অবসান ঘটে। সেই উত্তপ্ত, রক্তাক্ত পরিবেশে রাষ্ট্র এক অস্বাভাবিক শূন্যতায় পতিত হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেন, রাষ্ট্রপতি কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় থাকেন, প্রধান বিচারপতি ও অন্য শীর্ষ বিচারপতিরা আশ্রয় নেন ক্যান্টনমেন্টে। রাষ্ট্রযন্ত্র তখন কার্যত বিপর্যস্ত।
এই শূন্যতার মধ্যেই সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে আনা হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-কে। তবে এই সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করা হয়নি। পরে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি রেফারেন্স পাঠানো হয় আইনি ভিত্তির জন্য। কিন্তু তখন আদালত কার্যত অচল, প্রধান বিচারপতি নিরাপদ আশ্রয়ে—এমন প্রেক্ষাপটে সেই রেফারেন্স আদৌ কতটা বৈধ, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
এই কারণেই, জিল্লুর রহমানের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই ‘জাতীয় ঐক্য’কে নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতার প্রধান ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার কাজ হলো একটি জাতীয় সনদের খসড়া প্রণয়ন। এই সনদে সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি, সংসদের কাঠামো, ধর্মের ভূমিকা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোতে একটি সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের চেষ্টা চলছে।
তবে সমস্যা হলো—এই ঐকমত্য আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আদর্শিক পার্থক্য প্রকট। যেমন, জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ছোট দল পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি চায়, যেটিতে শতকরা ভোট অনুসারে সংসদীয় আসন বরাদ্দ হয়। এতে করে কম জনসমর্থন পেলেও এসব দল আসন পাবে। অন্যদিকে, বিএনপি ও কয়েকটি বড় দল প্রচলিত একক আসনভিত্তিক পদ্ধতি ধরে রাখতে চায়। প্রশ্ন উঠছে—যদি অধিকাংশ দল একমত হয় কিন্তু বিএনপি বা বড় দলগুলোর মতভেদ থাকে, তাহলে কি সেটিকে সত্যিকারের ‘জাতীয় ঐকমত্য’ বলা যাবে?
জিল্লুর রহমান সতর্ক করে বলেন, এখন সময় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হওয়ার। সংস্কার ও ঐকমত্যের নামে যদি কাউকে বাদ দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থের জন্য আত্মঘাতী হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ সংসদ গঠিত হতে পারে, এবং তারাই ঠিক করবে কেমন হবে সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামো।
সবশেষে তিনি বলেন, যদি এই ‘জাতীয় ঐক্য’ কেবল কল্পনালোকেই থাকে, তাহলে সেটি স্বীকার করে বাস্তবমুখী পথে হাঁটতে হবে। না হলে দেশ আবারও সহিংসতা, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার গভীরে পড়ে যাবে। এখন প্রয়োজন অবাধ, গ্রহণযোগ্য, দ্রুত ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের রূপরেখা—এটাই হতে পারে গণতন্ত্র পুনর্জাগরণের পথ এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ।