‘জাতীয় সরকার’ ইস্যুতে নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অসম্পূর্ণ—নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন কে এম নজমুল হক ফারদিন

বিএনপির ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং অনলাইন এক্টিভিষ্ট কে এম নজমুল হক ফারদিন সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব ঘিরে ২০২৪ সালের আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ এবং অভ্যন্তরীণ আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তার ভাষ্যমতে, এই ইস্যুতে নাহিদ ইসলামের সাম্প্রতিক মন্তব্য ছিল আংশিক, এবং তিনি নিজে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা ও দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে চেয়েছেন।

বিএনপির সাথে জাতীয় সরকার ইস্যুতে জনাব নাহিদ ইসলাম তার পোস্টে আজকে যা লিখেছেন, তা অসম্পূর্ণ। আমি এ পোস্টে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
৭ আগষ্ট ২০২৪-এ আনুমানিক ভোর ৪টায় নাহিদ ইসলাম আমাকে বলেন, ওনারা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্যারের সাথে দেখা করতে চান। তখন আমরা প্রায় সবাই শারীরিকভাবে বিধ্বস্থ। ১৫ দিন যাবত প্রতিদিন ১-২ ঘণ্টার বেশী ঘুমাতে পারিনি। ভাই-ব্রাদার কেউ কেউ আহত হয়েছে। চারদিকে অস্থির অবস্থা। দেশে কোন সরকার নাই। চলছে হানাহানি আর ডাকাতি। “র অ্যাটাক করেছে” বলে গুজব চলছে। সব মিলিয়ে হাসিনার পালানোটা ঠিকভাবে উদযাপন করতে পারি নাই।
যাইহোক মহাসচিব স্যারের বিশেষ সহকারী ইউনূস ভাইকে কল দিয়ে পেলাম না। স্যারকে কল দিয়েও রিচ করতে পারি নাই। পরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা স্যারের বড় মেয়ে শাহমারুহ আপাকে কাইফ কল দিয়ে বিষয়টা জানায়। উনি স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে স্যার আমাদের সবাইকে বাসায় যেতে বলেন। উল্লেখ্য উনি তখন শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। তখন হাসিনা না থাকলেও অনেক ধরনের রিস্ক ছিল। প্রত্যেকটা স্টেপ খুব সতর্কতার সাথে নিতে হচ্ছিলো। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে “ছাত্র নেতৃত্ব”-কে দেখভালের দায়িত্ব আমাদের উপর দেয়া হয়। আমানত হিসাবে সবাইকে কাজ করতে হয়েছে। দুইটা গাড়িযোগে গন্তব্যে পৌঁছালাম। স্যার এসেই সবার সাথে কোলাকুলি করেন। আমরা ড্রইং রুমে বসি। আলোচনা শুরু হয় সরকার ফরমেশন নিয়ে। এর আগেই ৫ আগষ্ট ও ৭ আগস্ট রাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে জুমে নাহিদ ইসলাম, মাফুজ আলম, আসিফ মাহমুদসহ প্রথম সারির সমন্বয়কদের সাথে মিটিং হয়। সেখানে গুরুত্বপুর্ণ আলোচনার অংশ A K M Wahiduzzaman স্যারের কাছে রেকর্ড করা আছে।
নাহিদ ইসলাম মহাসচিব স্যারকে বলেন আমরা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি এবং জুলাইয়ের স্টেক হোল্ডারদের মতামত নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে চাই। তখন মহাসচিব স্যার জিজ্ঞেস করেন, তোমরা যদি বিএনপির পক্ষ থেকে অফিসিয়াল প্রস্তাব চাও তাহলে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান সাহেবসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে আমরা প্রস্তাব দিবো। তখন মহফুজ আলম বলে, “আমরা সবার কাছ থেকে নামের সাজেশন চাচ্ছি। নাম দিলেই যে তাকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হবে ব্যাপারটা এমন নয়।”
আমাদের আইসিটি টিমের সদস্য সাদাফ ৫ আগস্ট দুপুরেই বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ভাইয়ের সাথে সেনা প্রধানের কার্যালয় গিয়েছিল। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওইখানে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে সেনাপ্রধান, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্য জোটের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু বিএনপি মহাসচিব এবং আব্বাস ভাই দুজনেই এর বিরোধিতা করেন। ঐদিন সন্ধ্যায় নাহিদরাও জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ের সংবাদ সম্মেলন করেছিল। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আমার মনে হয় জাতীয় সরকার গঠনে বিএনপি অস্বীকৃতি জানানোর কারণে ছাত্র সমন্বয়করা কিছুটা ক্ষিপ্ত ছিল।
বিএনপি যদি জাতীয় সরকারের যেত, তাহলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ বড় একটা অংশ বিএনপিকে দেয়া হত। কিন্তু তারপরেও কেন বিএনপি জাতীয় সরকারে গেল না?
১। বিএনপি সারাজীবন লড়াই করছে গণতন্ত্রের জন্য। এখন একটা গণতন্ত্রহীন জাতীয় সরকারে বিএনপি যদি যোগদান করতো, তাহলে বিএনপিকে দোষারোপ করা সহজ হতো এই বলে যে, সুযোগ পেলে বিএনপিও গণতন্ত্রহীনভাবে সরকারে বসে যায়। বিএনপি জাতির গণতান্ত্রিক ভাগ্যের সাথে বেঈমানি করে নাই। এখনও গণতন্ত্রের জন্যই লড়ছে।
২। বিএনপি যদি নাহিদদের সাথে জাতীয় সরকার তৈরী করতো, একবার ভেবে দেখেন তো এদেশের ভাগ্যে কী হতো? দেশের সবর্বশেষ বৃহৎ গণতন্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিএনপিও যদি গণতন্ত্রহীন পথ বেছে নিতো তাহলে এদেশের গণতন্ত্রের সূর্য চিরতরে ডুবে যেতো।
৩। একটা গণতন্ত্রহীন জাতীয় সরকারের ভিত্তি কী? কীভাবে সংসদের ৩০০ আসন সিলেক্ট হবে? কীভাবে জেলা উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি সিলেক্ট হবে? এইসব মৌখিক সিলেকশনের সাথে হাসিনা সরকারের ডামি জনপ্রতিনিধিদের পার্থক্য কোথায়? আমরা সিলেকশনে নয় ইলেকশনে বিশ্বাসী।
৪। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোন সরকারের অংশ যদি বিএনপি হতেই চাইতো, তাহলে আওয়ামীলীগের অসংখ্য লোভনীয় প্রস্তাব মুখের উপর ছুড়ে ফেলে দিতো না। এবং ১৭ বছর বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতেও হতো না।
৫। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে চায়। কারো অনুনয় বিনিময় বিএনপির কাছে ম্যাটার করে না। বিএনপি জেনে শুনে জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে নাই। কারণ দিল্লি কিংবা পিন্ডির জন্য না বিএনপির রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য।
জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে বিএনপির সম্মত হয়নি বলে নানাভাবে বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়। ভেবে দেখুন বিএনপির নামে তাদের এই কমপ্লেইনগুলোই বিএনপিকে নিয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলোচনা।
সম্পূর্ণ আলোচনা হলো, জনগণের ভোট ছাড়া একটা জাতীয় সরকারের অংশ হওয়া মানে জনগণের সাথে বেঈমানী করা। অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া। বিএনপি বাংলাদেশের সাথে কখনই বেঈমানী করেনি। একটা অগণতান্ত্রিক সরকারের অংশ বিএনপি কখনই হবে না। বিএনপি জনগণের ভোটে বিশ্বাসী আর সেটা আদায়ের লক্ষ্যেই বিএনপি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *