রাজধানীর ভাটারা এলাকায় এক কনভেনশন সেন্টারে গোপনে জড়ো করা হয়েছিল প্রায় ৪০০ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারকে—ভবিষ্যৎ নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনায়। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ঘটনার তিন সপ্তাহ পর, দেশজুড়ে তৈরি হয় তীব্র আলোড়ন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই আয়োজন কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়েই উঠছে বড় প্রশ্ন।
গত ৮ জুলাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাটারার একটি কনভেনশন সেন্টারে এ সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই হল ভাড়া নিয়েছিলেন শামীমা নাসরিন শম্পা, পরিচয় দিয়েছিলেন বিদেশে লোক পাঠানো সংস্থার প্রতিনিধির পরিচয়ে। যদিও প্রকৃতপক্ষে আয়োজনটি ছিল আওয়ামী লীগের গোপন বৈঠক ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে (Sheikh Hasina) পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ও দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা সংগঠিত করা।
এই বৈঠকের মূল আয়োজক হিসেবে উঠে এসেছে সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হক ও তার স্ত্রী পুলিশের এএসপি সুমাইয়া জাফরিনের নাম। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে মেজর সাদেকুলকে হেফাজতে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে ষড়যন্ত্রের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানায় সেনাবাহিনী।
প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু নিয়ে তদন্তে উঠে এসেছে, ওই কর্মশালাগুলোতে ক্যাডারদের সশস্ত্র ও ডিজিটাল যুদ্ধের কৌশল শেখানো হয়। রাজধানীর পূর্বাচল, কাঁটাবন ও মিরপুর এলাকাতেও আরও তিনটি একই ধরনের প্রশিক্ষণের তথ্য মিলেছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতে বিমানবন্দর ও শাহবাগ দখলের পরিকল্পনা ছিল বলেও জানা গেছে।
প্রশিক্ষণের চার দিন পর অর্থাৎ ১২ জুলাই বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, গোপালগঞ্জের নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পা এবং মেহেরপুরের যুবলীগ আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের তিনজনের বিরুদ্ধেই প্রশিক্ষণের পেছনে সরাসরি সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা গোয়েন্দা ব্যর্থতার বড় উদাহরণ। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির আওতায় থেকেও এত বড় পরিসরের ক্যাডার প্রশিক্ষণ কোনো বাহিনীর নজরে না আসা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “একটি কনভেনশন সেন্টারে দিনভর এত লোকের আনাগোনা, অথচ গোয়েন্দারা জানলেনই না সেখানে কী হচ্ছে? এটা এককথায় অদ্ভুত।”
এদিকে পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, রাজধানীজুড়ে ৫১টি গোয়েন্দা জোন রয়েছে, যেখানে সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এতগুলো ইউনিট থাকলেও কেন এমন স্পর্শকাতর একটি আয়োজন অজানা রইল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) (Special Branch) ২৮ জুলাই একটি সতর্কবার্তা জারি করে। এতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশব্যাপী সব ইউনিটকে রাজনৈতিক কার্যক্রমে নজরদারি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর পর্যবেক্ষণ এবং সাইবার গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সতর্কবার্তায় বলা হয়, ‘ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থান’ ঘিরে ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলো আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে, আর এই সুযোগে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীও উসকানিমূলক তৎপরতায় জড়াতে পারে।
এদিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও পেছনের নীলনকশা উন্মোচনে তদন্ত চলছে।
তালেবুর বলেন, “৮ জুলাইয়ের ওই গোপন বৈঠক সম্পর্কে আমাদের কাছে আগে থেকেই কিছু তথ্য ছিল। ভাটারা থানায় ১৩ জুলাই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।”
এই ঘটনায় রাজনৈতিক উত্তাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকার। বিশ্লেষকদের মতে, আগাম সতর্ক না থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এমন পরিকল্পনা আরও বড় বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে।