রাজধানীর গুলশান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রিয়াদ ও তার চার সহযোগীর পরিচয় প্রকাশের পর এক ভয়ঙ্কর মাদক চক্রের চিত্র সামনে এসেছে। তারা শুধু চাঁদাবাজই নয়—মাদক পরিবহন ও বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে শতাধিক তরুণ এখন সারা দেশে মাদকের নিরাপদ পরিবহন, বিক্রি এবং ভোক্তা তৈরির গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র জানায়, এই তরুণেরা মূলত ‘জুলাই আন্দোলন’-এর সময় বিভিন্নজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের মাদক সিন্ডিকেটে টেনে নেয়। ঢাকার অভিজাত অঞ্চলসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরের বার, মাদক আড্ডা এবং ক্লাবে তারা নিয়মিত চাঁদা তোলে। পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে মাদক বিক্রির ব্যবস্থাও করে। এদের কর্মকাণ্ড এতটাই প্রভাবশালী যে অনেক জায়গায় স্থানীয় মাদক কারবারিরা এখন তাদের কাছে নির্ভরশীল।
গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকায় ৫ আগস্টের পর মাদকের নিয়ন্ত্রণ একরকম দখল নেয় এই ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ধারীরা। প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে, দেয় টাকার প্রলোভন ও মাদক সেবনের সুযোগ। এরপর তাদের ব্যবহার করে নিরাপদে মাদক পরিবহন করা হয়। তাদের নেতৃত্বেই শতাধিক তরুণকে নিয়ে গড়ে ওঠে একটি নিরাপদ মাদক পরিবহন নেটওয়ার্ক।
সূত্র আরও জানায়, গত ১১ মাসে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সমুদ্র, স্থল এবং আকাশপথে মাদক প্রবেশের হার বেড়েছে বহুগুণ। এসব মাদক দেশের শহর, নগর, এমনকি পাড়া-মহল্লাতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝেও মাদক প্রবেশের একটি সুপরিকল্পিত প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমন্বয়ক পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্ত করে তুলছে তারা। অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে নেশার জালে আটকে পড়েছে।
সমন্বয়কদের অনেকেই রাতারাতি বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে কোটিপতি বনে গেছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা—এসব এলাকায় ভাগ হয়ে তারা গড়ে তুলেছে শক্তিশালী মাদক চক্র। তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে তাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে তারা।
এই ‘সমন্বয়ক’দের সংগঠন এককালীন, দৈনিক বা মাসিক চুক্তিতে টাকা নেয়। তাদের পেছনে রয়েছে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক বলয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (DNC)–এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মাদক কারবারিরা সবসময় ক্ষমতাধরদের সান্নিধ্য চায়। নানা উপায়ে তাদের ‘ম্যানেজ’ করা হয়। অল্প সময়ে ধনী হওয়ার লোভে অনেকেই ইয়াবা বা অন্যান্য মাদকের কারবারে জড়াচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, মাদক চক্রের সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত ও নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “প্রতিনিয়ত নতুন লোক যুক্ত হচ্ছে এই চক্রে। পুরোনো কারবারিরা তো ছিলই। তারা নতুন নতুন কৌশলে বিদেশ থেকে মাদক আনছে, বিক্রি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টার কমতি রাখছে না, কিন্তু আসল হোতারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।”