বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় গোপনীয়তার বিষয়টি এখনই উন্মুক্ত না করায় যাদের কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তাদের উদ্দেশে পরিষ্কার বার্তা দিলেন শেখ বশিরউদ্দীন (Sheikh Bashir Uddin)। তিনি জানালেন, এই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে এবং চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতে বিষয়টি প্রকাশ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশের দূতাবাসে নিযুক্ত প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা (Golam Mortoza)-র সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ওই ভিডিও পরবর্তীতে গোলাম মোর্তোজা তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড পেজে প্রকাশ করেন।
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘এই গোপনীয়তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচর্চার একটি স্বীকৃত অনুষঙ্গ। এমনকি স্থানীয় ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পদ স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও এমন বিধান থাকে। এটি অস্বাভাবিক নয়।’
তিনি যোগ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিকে নিজের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে, তাই তাদের পক্ষ থেকে গোপনীয়তার দাবি একেবারে অযৌক্তিক নয়। তবে, যদি কোনোভাবে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেই চুক্তি আমরা করব না—এটা আমাদের অবস্থান।’
চুক্তি গোপন রাখার বিষয়ে বিতর্কের মাঝেই তিনি জানান, আলোচনা চলাকালেই দুঃখজনকভাবে কিছু বিষয় ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তবে ফাঁস হওয়া তথ্যে এমন কিছু ছিল না যা সরাসরি দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। বরং, যেসব অংশে ক্ষতির ঝুঁকি ছিল, সেখান থেকে বাংলাদেশ সযত্নে সরে এসেছে।
নিজস্ব সক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। আত্মঘাতী কোনো চুক্তির মধ্যে প্রবেশ করলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা কারও কাম্য নয়।’
চুক্তির বাইরে এসে আলোচনায় উঠে আসে আরেকটি আলোচিত প্রসঙ্গ—বোয়িং (Boeing) থেকে ২৫টি বিমান কেনা নিয়ে চলমান জল্পনা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা সাফ জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বোয়িং বিমান কেনা নিয়ে কোনো বিষয়ই ওঠেনি। বরং বিষয়টি একমুখী—শুধুমাত্র একটি পক্ষের আগ্রহ থেকেই এসেছে।
তিনি বলেন, “গত বছর বোয়িং ১২টি বিমান তৈরি করেছে। সেই হিসেবে ২০৩৭ সালের আগে তারা নতুন কোনো বিমান সরবরাহ করতে পারবে না বলেই মনে হয়। এতে বোঝা যায়, ২৫টি বিমানের বিষয়টি বাস্তবতাসম্মত নয়।”
এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বিমানের সংখ্যার চেয়ে বেশি জরুরি এর পরিচালন সক্ষমতা। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার এই সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত এক কোটি যাত্রী পরিবহনের সুযোগ থাকলেও, কেবল বিমান কিনে লাভ নেই যদি তা পরিচালনার বাস্তব সক্ষমতা না থাকে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আসল আগ্রহ যে কৃষিপণ্য রপ্তানিতেই, সেটিও পরিষ্কার করে দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি জানান, বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের খাদ্যপণ্য আমদানি করে, যার একটি বড় অংশ আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এতে করে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ তুলা, সয়াবিন, ভুট্টা, গমজাতীয় কৃষিপণ্য আমদানি বাড়িয়ে অন্তত ২০০ কোটি ডলারের ঘাটতি কমাতে চায়—এই পণ্যগুলো এমনিতেই আমাদের আমদানি করতে হয়।”
সব মিলিয়ে, শেখ বশিরউদ্দীনের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, কূটনৈতিক শালীনতা, বাস্তবিক বাণিজ্য পরিস্থিতি এবং দেশের স্বার্থরক্ষাই চুক্তির মূল নির্ণায়ক। গোপনীয়তা নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন রয়েছে, তার জবাবও কৌশলে দিয়েছেন তিনি—চুক্তি চূড়ান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমেই সবকিছু জানানো হবে।