‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ বা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনের লক্ষ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও বিচারের দাবিসহ ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP)। আজ রোববার (৩ আগস্ট) বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ শীর্ষক এই ঘোষণায় দেশের বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর অধিকার, প্রবাসী অধিকার, জলবায়ু, পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা—সবকিছুতে ব্যাপক সংস্কার ও রূপান্তরের রূপরেখা তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তাঁর দাবি, এই ঘোষণাই হবে আগামী দিনের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনের ভিত্তি।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব। উপস্থিত ছিলেন সদস্যসচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কর্মীদের পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরাও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনে নতুন সংবিধান
ইশতেহারের প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, “উপনিবেশবিরোধী লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় একটি বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়তে হবে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে একটি নতুন সংবিধান।” এই সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ও পরিবারতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর বিলোপ, রাষ্ট্রীয় শক্তির ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, এবং নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনের দাবিকে কেন্দ্রীয় করে ঘোষণাপত্র ও ‘জুলাই সনদ’-কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচারের প্রতিশ্রুতি
দ্বিতীয় দফায়, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বিচার দাবি করা হয়। বলা হয়, “আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময় সংঘটিত সকল মানবতাবিরোধী অপরাধ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার” করা হবে।
রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের কাঠামোগত সংস্কার
তৃতীয় দফায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নির্বাহী কর্তৃত্ববাদ রোধে শক্তিশালী জবাবদিহিতার ব্যবস্থা। নির্বাচন কমিশনের গঠন ও নির্বাচনী ব্যয় কাঠামো সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, যাতে কালো টাকা ও প্রভাবশালীদের আধিপত্য রোধ করা যায়।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার
স্বাধীন বিচারবিভাগ, উপনিবেশকালীন আইন সংস্কার, ডিজিটাল মামলা ব্যবস্থাপনা, গরিবদের জন্য আইনগত সহায়তা এবং বিচার বিভাগীয় সচিবালয়কে আর্থিকভাবে স্বাধীন করার প্রতিশ্রুতি এসেছে চতুর্থ দফায়।
দুর্নীতি দমন ও সেবামুখী প্রশাসন
পঞ্চম দফায় আমলাতন্ত্রে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ, স্বচ্ছ নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও ‘Whistleblower Protection’ আইনের প্রণয়নের কথাও রয়েছে।
মানবিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পুলিশ সংস্কার
ষষ্ঠ দফায় র্যাব বিলুপ্তির ঘোষণা, পুলিশে বডি ক্যামেরা চালু, ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা এবং মানবাধিকার ভিত্তিক পুলিশি প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ও গ্রাম পার্লামেন্ট
সপ্তম দফায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রামে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে শহরের চাপ কমানোর পরিকল্পনা এসেছে। বলা হয়েছে, গ্রাম পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ‘গ্রাম পার্লামেন্ট’ গঠিত হবে।
গণমাধ্যম স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজ শক্তিশালীকরণ
অষ্টম দফায় রয়েছে গুজব ও মিথ্যা তথ্য দমনে আইনি কাঠামো, প্রেস কাউন্সিলের কার্যকরীকরণ এবং মিডিয়া মালিকানা সীমিতকরণের প্রস্তাব। নাগরিক সমাজের ভূমিকা শক্তিশালী করতে নীতিকাঠামো গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য
নবম দফায় বৈষম্যহীন ও ডিজিটাল হেলথ রেকর্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানসিক স্বাস্থ্য, রেফারেল সিস্টেম এবং জিপিএসচালিত অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে।
শিক্ষা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্য
দশম দফায়, শিক্ষা বাজেট বাড়ানো, একীভূত পাঠ্যক্রম, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, শিক্ষক মর্যাদা, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণসহ শিক্ষাখাতে নীতি সংষ্কারের বিস্তারিত পরিকল্পনা এসেছে।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণার অঙ্গীকার
একাদশ দফায় গবেষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো প্রযুক্তি, কিউবিক কম্পিউটিং ও সাইবার নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের ল্যাব ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ধর্মীয় ও জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্তি
দ্বাদশ দফায় জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক বৈচিত্র্যের মর্যাদা রক্ষায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মাতৃভাষা শিক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি এসেছে।
নারীর অধিকার ও সুরক্ষা
নারী সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন, সমান বেতন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা এবং ব্রেস্টফিডিং সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গৃহিনীদের অর্থনৈতিক অবদান স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও বলা হয়।
মানবিক ও কল্যাণভিত্তিক অর্থনীতি
চতুর্দশ দফায় বলা হয়, “অর্থনীতি হবে মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে জিডিপির চেয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার বড়।” প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে কর সংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও ব্যাংক খাতে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
তারুণ্য ও কর্মসংস্থান
পনেরোতম দফায় তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন, ইন্টার্নশিপ, ফ্রিল্যান্সিং ও বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পনীতি
ষোড়শ দফায় চামড়া, আইসিটি, ওষুধ ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাতে রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং চট্টগ্রাম ও মংলাকে লজিস্টিক হাবে পরিণত করার পরিকল্পনা এসেছে।
টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব
কৃষিকে লাভজনক ও নিরাপদ করতে তথ্যভিত্তিক নীতি, প্রযুক্তি নির্ভরতা, পণ্যের ন্যায্য দাম, জৈবচাষে ভর্তুকি ও নিরাপদ খাদ্যের জন্য বায়োসার্ভেইল্যান্স গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়।
শ্রমিক-কৃষকের অধিকার
নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো, বাধ্যতামূলক কর্মবীমা, শ্রম আদালতের সক্ষমতা বাড়ানো এবং স্মার্ট কৃষির প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে।
জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা
কয়লা, গ্যাস, খনিজ সম্পদ এবং সমুদ্র সম্পদ উত্তোলনে স্থানীয় অধিকার, টেকসই ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বার্থরক্ষার জোরালো অবস্থান প্রকাশ করা হয়।
পরিকল্পিত নগর ও পরিবহন ব্যবস্থা
বসবাসযোগ্য শহরের জন্য নদীকেন্দ্রিক নগর উন্নয়ন, গণপরিবহন, ভাড়া নীতি, আবাসন, এবং এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের ঘোষণা আসে।
জলবায়ু সুরক্ষা ও পরিবেশনীতি
জলবায়ু হুমকি মোকাবিলায় টেকসই অবকাঠামো, পরিবেশবান্ধব শক্তি ও সুনীল অর্থনীতির রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রবাসী অধিকার
রেমিট্যান্স প্রেরক প্রবাসীদের ভোটাধিকার, সম্মানজনক সেবা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলা হয়।
স্বাধীন ও দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতি
পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘অপদলীয়’ কূটনীতির প্রত্যয় ঘোষণা করে এনসিপি।
সমন্বিত প্রতিরক্ষা কৌশল
শেষ দফায় উঠে এসেছে বিমান প্রতিরক্ষা, সাবমেরিন-নৌবাহিনী, ড্রোন ব্রিগেড ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের পরিকল্পনা।
‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের আহ্বান’
নাহিদ ইসলাম বলেন, “এক বছর আগে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আমরা শপথ নিয়েছিলাম। আজ সেই শপথ বাস্তবায়নের পথে আমরা অনেকটা এগিয়েছি। এবার ঐক্যবদ্ধভাবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গড়তে হবে। এই ২৪ দফাই হবে আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশ।”