জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের খসড়া ও বিএনপি (BNP) প্রস্তাবিত সংশোধনীর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। প্রতিটি দফায় ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, ভাষাগত শব্দচয়ন ও রাজনৈতিক অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে এই পার্থক্য। নিচে দফাভিত্তিক তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:
১ম দফা: মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা ঘোষণা
**সরকারের খসড়ায়
‘এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে জাতীয় মুক্তির জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।’
বিএনপির সংশোধনী:
উপরোক্ত বক্তব্যের সঙ্গে অতিরিক্তভাবে ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করে’ বাক্যটি যুক্ত করা হয়েছে।
৪র্থ দফা: বাকশাল ও গণতন্ত্র
সরকারের খসড়ায়:
‘স্বাধীনতা–পরবর্তী আওয়ামী সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahman) কর্তৃক বাকশাল নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে…’
বিএনপির সংশোধনী:
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে শুধু বলা হয়েছে, ‘বাকশালের নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়’।
সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে:
‘১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদলীয় বাকশালব্যবস্থা বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করা হয়।’
৮ম দফা: আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও দুঃশাসন
সরকারের খসড়ায়:
‘বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার (Sheikh Hasina) এর দুঃশাসন, পিলখানা ট্র্যাজেডি, শাপলা চত্বরে গণহত্যার মতো আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ উল্লেখ করা হয়।
বিএনপির সংশোধনী:
‘পিলখানা ট্র্যাজেডি, শাপলা চত্বরে গণহত্যা’—এই অংশ বাদ দিয়ে অগণিত বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের কথা যদি করা হয়েছে।
১৭তম দফা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও নির্যাতনের বর্ণনা
সরকারের খসড়ায়:
‘ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারী-শিশুসহ প্রায় দুই সহস্র মানুষকে নির্বিচার হত্যার’ কথা বলা হয়।
এছাড়াও বলা হয়:
‘দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ পাশবিক নির্যাতন চালায়, অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে। ফলে ছাত্ররা ৯ দফা ঘোষণা করে, যা পরবর্তীতে ১ দফায় রূপান্তরিত হয় এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে।’
বিএনপির সংশোধনী:
– ‘দুই সহস্র’ শব্দ পরিবর্তন করে ‘দুই সহস্রাধিক’ করে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারী-শিশুসহ প্রায় দুই সহস্রাধিক মানুষকে নির্বিচার হত্যা করা হয়, অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বারণ করে। যার প্রেক্ষিতে প্রথমে ৯ দফা ঘোষণা করা হয়, যা পরবর্তীতে ১ দফায় রূপান্তরিত হয় এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে।
১৯তম দফা: শেখ হাসিনার পদত্যাগ
সরকারের খসড়ায়:
‘তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে এবং তিনি তার মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও অন্যান্য সংসদ সদস্যসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’
বিএনপির সংশোধনী:
শুধু এই অংশ রাখা হয়েছে:
‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়’।
‘তার মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও অন্যান্য সংসদ সদস্যসহ’ কথাগুলো রাখেনি।
সংবিধানে সংযুক্তি প্রসঙ্গে
সরকারের প্রস্তাব:
ঘোষণাপত্রটি সংবিধানের প্রস্তাবনা ও তফসিলে সংযুক্ত করার প্রস্তাব ছিল।
বিএনপির অবস্থান:
শুধুমাত্র চতুর্থ তফসিলে সংযুক্ত করার বিষয়ে একমত।
সারসংক্ষেপ
এই দফাভিত্তিক পার্থক্যগুলো দেখায় যে, বিএনপি একদিকে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় কিছু অংশ জোরদার করেছে (যেমন: ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা), আবার অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অংশ (যেমন: শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা দেশত্যাগ) সচেতনভাবে বাদ দিয়েছে। ঘোষণাপত্রের এই সংশোধিত রূপ এখন প্রধান উপদেষ্টা কিভাবে ঘোষণা করবেন, সেটি আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।