সংস্কারের জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিশেষ করে অঙ্গীকারনামা অংশে কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)। সংবিধানের ওপর সনদের প্রাধান্য, আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ সীমিতকরণ এবং আপিল বিভাগকে সনদের ব্যাখ্যার ক্ষমতা দেওয়ার অঙ্গীকারে পরিবর্তন আসছে।
সংবিধান ও সনদের প্রাধান্য
পূর্ণাঙ্গ খসড়ার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছিল, বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের ওপরে জুলাই সনদকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু বিএনপি (BNP) এ প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। তারা মনে করে সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া যাবে না। যদিও জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) এবং এনসিপি (NCP) এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আপত্তির কারণে ভাষাগত পরিবর্তন এনে বলা হচ্ছে—সংস্কারের যেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, সেই ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানের চেয়ে প্রাধান্য পাবে সনদ।
আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ
চতুর্থ দফায় বলা হয়েছিল, সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপি বলেছে, এতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। কমিশন জানিয়েছে, পরিবর্তন এনে বলা হতে পারে—সই করা কোনো দল আদালতে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন এ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে।
আপিল বিভাগের এখতিয়ার
তৃতীয় দফায় আপিল বিভাগকে সনদের ব্যাখ্যার একক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। তবে বিএনপিসহ আটটি দল এর বিরোধিতা করে। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তন হবে, তার ব্যাখ্যা আপিল বিভাগের এখতিয়ারেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পড়বে। তাই আলাদা অঙ্গীকার রাখার প্রয়োজন নেই।
বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতবিরোধ রয়েছে। কিছু দল গণভোট চায়, কেউ সাংবিধানিক সভা বা গণপরিষদ, আবার কেউ রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি ও কয়েকটি দল বলছে, কেবল সংসদই সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। এই কারণে বাস্তবায়ন পদ্ধতি সনদের অংশ না রেখে সুপারিশ আকারে সরকারকে দেওয়া হবে।
কমিশনের অবস্থান
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলের মতামত সমন্বয় করে শিগগির চূড়ান্ত খসড়া দেওয়া হবে, এরপর আর কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এমন অঙ্গীকার রাখা হচ্ছে, যা আইনি ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে।
কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে, অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। কোনো দল সই না করলে কমিশনের আর কিছু করার নেই।
ঐকমত্য ও মতপার্থক্য
দুই দফা সংলাপের পর ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৭৩টিতে দলগুলো একমত হয়েছে। তবে ১১টি প্রস্তাবে কিছু কিছু ধারায় এখনো আপত্তি থেকে গেছে। এর মধ্যে ৯টিতেই বিএনপির আপত্তি রয়েছে—যেমন যে প্রক্রিয়ায় উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে , দুর্নীতি দমন কমিশন ও সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া। বিএনপি জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তারা এসব প্রস্তাব তাদের দেওয়া ৩১ দফার আলোকে বাস্তবায়ন করবে।
পরবর্তী ধাপ
আজ বৃহস্পতিবার আবার বৈঠকে বসছে কমিশন। জানা গেছে, এই বৈঠকেই চূড়ান্ত খসড়ার রূপ দেওয়া হবে। গতকালের বৈঠকে ড. আলী রীয়াজ, বদিউল আলম, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।