ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনি জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami)। দলটি প্রাথমিকভাবে সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি বেশ কিছু ইসলামী ও সমমনা দলকে নিয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, মূলধারার মধ্যপন্থি রাজনৈতিক শক্তিগুলো জামায়াত নেতৃত্বাধীন কোনো জোটে যেতে আগ্রহী নয়। ফলত, জামায়াতের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছে ধর্মভিত্তিক ছোট ছোট দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পথ।
জানা গেছে, এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক নির্বাচনি জোটের রূপরেখা না থাকলেও, পিআর পদ্ধতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, এবং ‘জুলাই সনদ’-এর আইনি বাস্তবায়ন ইস্যুতে অন্তত ৯টি দল জামায়াতের সঙ্গে একমত। জামায়াতের নেতৃত্বে যারা এখন যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (Islami Andolan Bangladesh), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জাগপা (JAGPA), এবং নেজামে ইসলাম পার্টি। এই দলগুলোর অভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা একটি সম্ভাব্য জোটের ভিত্তি গড়ে তুলছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, এখনো জোট গঠনের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়নি, তবে আলোচনার ভিত্তিতে ইসলামপন্থি দলগুলোর নিয়ে একটি নির্বাচনি ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে।
তবে একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটছে মধ্যপন্থি ও নতুন ধারার দলগুলো। এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, আপ বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল নিজেদের আলাদা একটি মোর্চা গঠনের চেষ্টায় আছে। এই মোর্চা পরবর্তীতে বিএনপি বা অন্য কোনো বৃহৎ জোটের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় যেতে পারে। তবে তারা স্পষ্টভাবে বলছে—জামায়াত নেতৃত্বাধীন ধর্মভিত্তিক জোটে তারা নেই।
এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল বলেন, ‘শুধু ধর্মভিত্তিক জোটে আমরা থাকব না। আর জামায়াত নেতৃত্বের জোটেও নয়।’ এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদও স্পষ্ট করেছেন, তারা এখনো নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান বলছেন, তারা জাতীয় সরকারের ধারণা নিয়ে এগোচ্ছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যই তাদের লক্ষ্য।
অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে। খেলাফত আন্দোলনের মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ‘ইসলামপন্থিদের যেন একক প্রার্থী থাকে, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।’ একই সুরে কথা বলেছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ এবং যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল জলিল। তাদের মতে, ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের দাবি আদায় না হলে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে দলগুলো।
যদিও যুগপৎ কর্মসূচির মধ্যে নির্বাচনি জোটের রূপরেখা এখনো সুস্পষ্ট নয়, তবে ইসলামী দলগুলোর নেতারা ধারণা করছেন, নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর সমঝোতা হবে। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ‘আমরা চাই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচন। জামায়াতের নেতৃত্বে একটি নতুন জোট গঠনেরও সম্ভাবনা রয়েছে।’
তবে মূল প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—এই ধর্মভিত্তিক জোট কতটা কার্যকর হবে, বিশেষ করে যখন বিএনপির মতো বড় শক্তির সঙ্গেও তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো সংযুক্তি নেই, এবং মধ্যপন্থি শক্তিগুলোও একেবারে আলাদা পথে হাঁটছে।
ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরপন্থিদের সাম্প্রতিক বিজয় জামায়াতপন্থিদের মধ্যে আশা জাগালেও, জাতীয় রাজনীতিতে তা কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই পরিষ্কার হচ্ছে—মধ্যমপন্থা ও নতুন রাজনৈতিক ধারার দলগুলো নিজেদের কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত। তারা জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে নিজেদের ছক কষছে। অন্যদিকে জামায়াত তাদের পুরনো শরিক ইসলামপন্থি দলগুলো নিয়েই একমাত্র সম্ভাব্য পথ খুঁজছে। একদিকে বিএনপিকে নিয়ে অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে মূলধারার দলগুলোর অনীহা—সব মিলিয়ে জামায়াতের শেষ ভরসা এখন কেবল ইসলামপন্থিরা।