বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন (Proportional Representation – PR) পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকারের পতন, সংবিধান সংস্কার , গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের উদ্বেগের ভেতরেই আলোচনায় এসেছে এই পদ্ধতি। তবে বিষয়টি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়—প্রতিবেশী ভারত যে এই প্রক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয়, তা নিয়ে এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে।
ভারতের ভূরাজনৈতিক হিসাব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক ও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিযোগ—ভারত পিআর পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছে। কারণ স্পষ্ট: একটি বিভক্ত সংসদে ক্ষমতার ভারসাম্য এমনভাবে থাকবে, যা অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে দুর্বল করবে এবং দেশের কূটনৈতিক নীতিকে অনেকাংশে ভারতনির্ভর করে তুলবে। এই দুর্বল রাজনৈতিক কাঠামো ভারতের জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করে, বিশেষ করে যখন ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি তাদের নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যনীতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
পিআর পদ্ধতির ফলে একাধিক ছোট দল সংসদে আসন পাবে, যারা এককভাবে নীতিনির্ধারণে সক্ষম নয়। এই ধরনের ছিন্নভিন্ন রাজনৈতিক পরিসরে ভারত ‘স্ট্যাবিলাইজিং ফোর্স’ বা ‘মধ্যস্থ শক্তি’ হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে। একদম ভারতীয় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পর্যালোচনার এজেন্সী গুলো মতে —বাংলাদেশে ক্ষমতা ভাগাভাগির এই মডেল ভারতের পক্ষে ‘সহজ নিয়ন্ত্রণযোগ্য’।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা না, বরং রাজনৈতিক হাতিয়ার
ভারত একদিকে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে, অন্যদিকে সেই উদ্বেগকে ব্যবহার করছে কৌশলগত চাপ হিসেবে। ইসলামপন্থী দলগুলো যদি বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করে, তাহলে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় সহিংসতার ঝুঁকি বাড়তে পারে—এই বক্তব্য ভারত সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরে। কিন্তু এর মধ্যেই একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে। ভারতের মতে, একটি বিভক্ত সরকার ইসলামপন্থী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হবে না—বরং ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করবে, আর সেটাই তাদের আসল লক্ষ্য।
এই যুক্তির পেছনে রয়েছে একরকম ভীতি সঞ্চার কৌশল। বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান হলে তা সরাসরি ভারতের সীমান্ত এলাকাকে প্রভাবিত করবে—এমন আশঙ্কা তুলে ধরে তারা পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতিতে ‘নিরাপত্তাবান্ধব’ ব্যালেন্স’ তৈরির চেষ্টা করছে। অথচ বাস্তবে এই ব্যালেন্স ভারসাম্যের চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে নিরপেক্ষতা বিনষ্টকারী এক পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো।
ভারতের ‘অস্থায়ী সরকার’ ন্যারেটিভ ও নজরদারির কৌশল
সম্প্রতি ভারতীয় কূটনৈতিক মহলে এক ধরনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে—বাংলাদেশে ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন কাঠামো গড়ে তোলার। এই আগ্রহকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন অস্থায়ী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প মডেল হিসেবে, যেখানে ভারত চাইছে একটি নির্বাচনকালীন অংশীদারিত্বমূলক সরকার চালু হোক—পিআর পদ্ধতি তারই একটি উপকরণ।
পিআর পদ্ধতিতে সর্বদলীয় সরকার গঠনের যুক্তি উঠে আসে, যেখানে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও কেউই পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ঠিক এই মুহূর্তেই ভারত প্রবেশ করতে চায় ‘সিদ্ধান্ত-পরামর্শদাতা’ বা ‘আঞ্চলিক বন্ধু’ রূপে, যা আদতে মূকনিয়ন্ত্রণ (Silent Control) নীতির বাস্তবায়ন।
গণতন্ত্র না ভূ-রাজনীতি?
এখানে প্রশ্ন উঠে যায়—ভারতের এই আগ্রহ কি সত্যিই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য, নাকি এটি একপ্রকার ‘বাই ডিফল্ট নিয়ন্ত্রণ’ কৌশল? PR পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কার্যকর হলেও, বাংলাদেশে এই পদ্ধতি প্রয়োগের বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও দলের আনুগত্য এবং দলীয় শৃঙ্খলার ভেতরে আবদ্ধ। পিআর পদ্ধতির ফলে তৃণমূলের রাজনৈতিক জবাবদিহিতা আরও কমে আসবে, এবং সেই সুযোগে বহিঃশক্তির কৌশলগত হস্তক্ষেপ আরও সহজ হবে।
পিআর নয়, প্রয়োজন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কারে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বা পরামর্শ অস্বীকারযোগ্য নয়। কিন্তু কোনো পদ্ধতি চালুর পেছনে প্রতিবেশী দেশের কৌশলগত অভিসন্ধি থাকলে সেটি গণতন্ত্র নয়, বরং স্বাধীনতার উপর ছদ্ম-আধিপত্য চাপিয়ে দেয়। ভারতের চাওয়া যদি সত্যিই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ হয়ে থাকে, তাহলে তা পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক বিভাজন ঘটিয়ে নয়—বরং একটি বিশ্বস্ত, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই সম্ভব।
ডাঃ ফেরদৌস কবীর
সম্পাদক, তাজাখবর