নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি সংস্কার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি : জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশের সার্বিক সংস্কার কার্যক্রমও সমান তালে এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা তুলে ধরেন।

প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে স্মরণ করেন, এই বছর দেশ ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এর প্রথম বার্ষিকী উদযাপন করেছে—যেখানে তরুণ সমাজ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। তিনি বলেন, “সেই অভ্যুত্থান আমাদের সামনে বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব আমাকে ও আমার সহকর্মীদের হাতে এসেছে, আর এর জন্য প্রয়োজন ছিল ভেঙে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোর পুনর্গঠন।”

তিনি স্পষ্ট করে জানান, নির্বাহী আদেশের সহজ পথ পরিহার করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সংস্কারের কষ্টকর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য হলো এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসক বা ক্ষমতার অপব্যবহারকারী নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটবে না।

ড. ইউনূস জানান, শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি দমন ও নারী অধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কার তদারকির জন্য ১১টি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এর ফলেই ‘জুলাই ঘোষণা’-য় রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার বাস্তবায়নে সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার প্রকাশ করে, যাতে নির্বাচনের পরেও এই প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়।

মানবাধিকার ইস্যুতেও সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানান স্বৈরশাসক আমলে সংঘটিত নৃশংসতা তদন্তের জন্য। তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ ইতোমধ্যেই সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগ দিয়েছে, নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকলেও স্বাক্ষর করেছে। এ লক্ষ্যে একটি স্বাধীন জাতীয় প্রতিরোধমূলক কাঠামো গঠনের কাজ চলছে।

অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও সম্পদ আত্মসাতের ভয়াবহতা নিয়েও কঠোর অবস্থান জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক স্বার্থে নেওয়া বহু অবকাঠামো প্রকল্প অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। এখন সংস্কারের মাধ্যমে এই চক্র ভাঙা হচ্ছে, যাতে উন্নয়নকে আর কখনোই সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার করা না যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মধ্যে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার পরিবর্তনকে সামনে আনেন তিনি। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থা পৃথক করার আইন ইতোমধ্যেই পাস হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। এই পদক্ষেপ সদ্যসমাপ্ত FFD4 সম্মেলনে গৃহীত সেভিয়া অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অবৈধ অর্থপাচার ঠেকানো ও বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরানো এখন সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়, “শত শত কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি তা ফেরানোর, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের সদিচ্ছা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়।” তিনি আহ্বান জানান, যে দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো পাচারকৃত অর্থ গচ্ছিত রেখেছে তারা যেন অপরাধের শরিক না হয়, বরং প্রকৃত মালিক—কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের কাছে অর্থ ফিরিয়ে দেয়।

শেষে তিনি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলা, অবৈধ অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং পাচারকৃত সম্পদ ফেরাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *