বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নুরুল কবির বলেছেন, ‘যারা একটা পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যার সঙ্গে পাকিস্তানিদের পরিচালনায় গণহত্যার সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, জামায়াত ইসলামী যদি আশা করে যে তাদেরকে প্রশংসা করতে হবে, তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলতে হবে, এই আশা করাটা খুবই অন্যায়। তাদের দিক থেকে কিন্তু তারা এই অন্যায়টা বোঝে না। তাদের বিরুদ্ধে বললেই আমাদেরকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দেয়।
তিনি মনে করেন, জামায়াতের বিচার এখনো সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি এবং দল হিসেবে তাদের বিচার হওয়া জরুরি।
অতীতের নৃশংস অপরাধ এবং সমাজে তাদের অব্যাহত প্রভাব যথাযথ বিচারহীন থাকলে দেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু ব্যক্তিগত নয়, দলীয় পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাই সময়ের দাবি।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশনের ‘তৃতীয় মাত্রায়’ অংশ নিয়ে নুরুল কবির এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালন করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান।
নুরুল কবির বলেন, পৃথিবীতে নানা রকম নিপীড়ন, অবিচার ও অত্যাচার আছে কিন্তু নারী সমাজের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ঘৃণিত অপরাধগুলোর মধ্যে ধর্ষণের স্থান শীর্ষে। কোনো মেয়েকে গণধর্ষণ করা এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকদের বিচারবোধ উদ্বেগজনক। তাদের বিচারবোধ এমন যে, যদি সমাজে কারো আচরণ তাদের পছন্দ না হয় তখন তাকে শাস্তি হিসেবে অত্যাচার করা উচিত—এমন মানসিকতাকে তারা ন্যায়সংগত মনে করে। তাই সমাজকে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, জামায়াত ইসলামী একটি ভিন্ন ধরনের ফ্যাসিবাদী আচরণ বহন করছে। যারা তাদের ইচ্ছে মত নয় তাদের গালি দেয়, গালমন্দ করে, ব্র্যান্ডিং করে এবং এমনকি মেয়েদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মত বর্বর উপায়কে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রচার করে। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগ্রাম একসঙ্গে না চললে বাংলাদেশ কখনও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে না।
নুরুল কবির বলেন, যে রাজনৈতিক দল পৃথিবীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সেই দলের প্রভাব এবং সমর্থন যখন সমাজে বৃদ্ধি পায়, তখন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের উচিত ছিল তা গভীরভাবে ভাবা। কিন্তু আমার মনে হয়, তারা তা করেনি।
বরং এই বিকাশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নানাভাবে তাদের সহযোগিতা করেছে। কখনো জামায়াত ইসলামীকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, কখনো বিএনপির পক্ষ থেকে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটার সংখ্যা বাড়ানোর কৌশলগত কারণে নৈতিকতা ত্যাগ করে তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে তাদের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে জামায়াতের কেন সমর্থন বেড়েছে। তার দুটি বড় কারণ আছে। প্রথমত, তারা সাংগঠনিকভাবে চিন্তা করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আসছে। সবচেয়ে খারাপ ছাত্রও যদি পুরো বছর পরিশ্রম করে তার একটা ফলাফলের প্রত্যাশা থাকে; ঠিক তেমনি জামায়াত ইসলামী গত ৫০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক স্থাপন করেছে। তবে এটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির শাসনামলে তাদের নীতি ও আইনি সহযোগিতার মধ্যেই সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জামায়াত ইসলামী একটি ক্যাডারভিত্তিক দল, যার নিজস্ব নিয়মনীতি রয়েছে। এই নিয়মনীতি মানুষ চাক্ষুষ করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিয়মনীতির চেয়ে এটি কার্যকর মনে হয়েছে।
তিনি মনে করেন, শুধু সুশৃঙ্খল দল হওয়াই একটি দলকে গণতন্ত্রপরায়ণ বা ভালো রাজনৈতিক দল বানায় না। গুরুত্বপূর্ণ হলো দলের রাজনৈতিক আদর্শ। উদাহরণস্বরূপ, হিটলারের দল অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ ছিল কিন্তু তার আদর্শ ন্যায়সংগত ছিল না। অর্থাৎ নিয়ম-কানুন মেনে শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়া মানেই কোনো দলকে ভালো রাজনৈতিক দল বানায় না—এই বিষয়টি সমাজে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। যার ফলে জামায়াতের সমর্থন বেড়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে নুরুল কবির বলেন, যদি ইউনূস সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকে এবং তার সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা থাকে, তাহলে তার উচিত হবে সমস্ত শক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশন, আইন, প্রশাসন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে সংগঠিত করা। অন্তত আমি অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি বিশ্বাস রাখি যে তিনি এটি চাচ্ছেন। তাই আমার অনুমান, নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই নির্বাচনের গুণগত মান কেমন হবে, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বার বার বলছেন ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে এবং সেটিই এখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা। তবে দীর্ঘ দিন নির্বাচনহীন সময়ে সমাজে যে রক্তপাত এবং বিশৃঙ্খলা হয়েছে তা কাটিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য যে যোগ্যতা, সামর্থ্য ও চিন্তার প্রয়োজন, তা তাদের কাছে আছে কিনা সন্দেহজনক। অনেক রাজনৈতিক নেতার অভিজ্ঞতা নেই; মন্ত্রীরা প্রায়শই এসব দলের সঙ্গে কোনো অর্গানিক যোগাযোগ রাখেন না এবং রাজনৈতিক দরকষাকষি বা সমঝোতার অভিজ্ঞতা নেই। এই সমস্ত পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচনের গুণগত মান বা ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ হওয়ার আশাবাদ আমি দেখি না। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিন্তু তার মান সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে।
দল হিসেবে জামায়াতের বিচার প্রসঙ্গে নুরুল কবির বলেন, জামায়াত ইসলামীর বিচার বা ৭১ এ তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আমি আমার কৈশর থেকে চাই। আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতের এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন আমি পত্রিকা ও ব্যক্তিসত্তায় সাংবাদিক হিসেবে এটি সমর্থন করেছি। একই সঙ্গে, সেই বিচারটি যেন সুষ্ঠু হয় আমরা তার পক্ষে বলেছি। কিন্তু পরে আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো যে এই বিচার প্রক্রিয়া এক পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত আদালতে সবার ফাঁসি হওয়ার মতো রায় আসছে। এটি যখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়, আমি এর বিরুদ্ধে লিখেছি। লিখার কারণে আমাকে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে। জামায়াত ইসলামের বর্বর কর্মী ও সমর্থকরা এটা ভুলে গেছে। আমি শুধু অন্যায়ভাবে বিচার না হোক, তা লিখে ও প্রকাশ করতে গিয়ে আদালতের শুনানিতে আমাকে অংশ নিতে হয়েছিল এবং লড়াই করে মুক্ত হতে হয়েছে। আমি মনে করি, এখনো পর্যন্ত দল হিসেবে জামায়াত ইসলামের বিচার হওয়া দরকার। একইভাবে, জুলাই–আগস্ট মাসের ওই তিন সপ্তাহের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা করেছে তারও দলীয়ভাবে বিচার হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বর্তমানে শুরু হওয়া বিচার প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগ নেতারা বা মন্ত্রীরা ‘হুকুমদাতা’ বা ‘সুপিরিয়র দায়িত্বশীল’ হিসেবে অভিযুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওই দলের কোনো নেতা সেই হত্যাযজ্ঞের সময় প্রকাশ্যে বা বিশ্বাসযোগ্যভাবে কোনো প্রতিবাদ, রেজোলিউশন বা অবস্থান নিয়েছিল কি না। আজ পর্যন্ত তাদের কোনো অপরাধবোধ বা অনুতাপ দেখা যায় কি না—এটিও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জামায়াত ইসলামী তার অপরাধ স্বীকার করে না ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও তা স্বীকার করে না। তাই দলীয়ভাবে তাদের বিচার হওয়া দরকার।