নীরবেই পার হয়ে গেলো ১৩ অক্টোবর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী ড. পিয়াস করিম-এর দশম মৃত্যুবার্ষিকী। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন এক যুক্তিনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান ও সম্মানিত নাগরিক, যিনি যুক্তির শক্তিতেই কথা বলতেন, বুদ্ধির বিশ্লেষণেই সত্য প্রকাশ করতেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বাংলাদেশে যখন কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না , আজ যারা বড় বড় বিপ্লবী সেজে বাংলাদেশকে একদিনেই পরিবর্তন করে দেবার স্বপ্ন দেখান, তারা যখন বুক ফুলিয়ে শাহবাগী সেজে ঘুরে বেড়াতেন, সেই সময় দেশের যে গুটিকয়েক সাহসী ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এসে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, পিয়াস করিম ছিলেন তাদের একজন। তার মূল্য তাকে চুকাতে হয়েছে অনেক ভাবেই।
২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর, ভোর ৫টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। কিন্তু মৃত্যুর পরপরই তাঁকে ঘিরে শুরু হয় এক বিতর্কিত অধ্যায়—কিছু টেলিভিশন চ্যানেল তাঁর মরদেহ সামনে রেখে আপত্তিকর ও মিথ্যা প্রচারণা চালায়। একই সঙ্গে তাঁকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে শহীদ মিনারে মরদেহ আনার প্রচেষ্টা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ সাতটি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি মুহাম্মদ সামছুল ইসলাম ও ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমও। তাঁরা ঘোষণা দেন, সকাল ৯টা থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান করবেন যেন পিয়াস করিমের মরদেহ সেখানে আনা না যায়।
অন্যদিকে, পিয়াস করিমের স্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমেনা মহসিন মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অনুমতি মেলেনি।
সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জানায়, শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা যাবে না। নিরাপত্তার অজুহাতে রাস্তার দুই পাশে মোতায়েন করা হয় হাজার হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে দেশের সাধারণ মানুষ সেইদিন শহীদ মিনারের পরিবর্তে জাতীয় মসজিদেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
ড. পিয়াস করিম ছিলেন যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তার ধারক, যিনি অল্প সময়েই সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পান। চিন্তা ও চেতনার পরিসরে তিনি ছিলেন আধুনিক, প্রগতিশীল ও মানবিক মানসিকতার মানুষ।
তবে মৃত্যুর পরপরই তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে চালানো হয় ‘রাজাকার’ প্রচারণা, যা পরবর্তীতে সরকারপ্রধানের মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের বক্তব্যে সম্পূর্ণভাবে খণ্ডিত হয়।
তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলেন, “ড. পিয়াস করিম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারপত্র বিলি করছিলেন। তিনি রাজাকারের নাতি বা ছেলে নন।”
তিনি আরও বলেন, “পিয়াস করিমের নানা ছিলেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আর তাঁর বাবা ছিলেন ঐ জেলার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ। তাই তাঁকে রাজাকার বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
ড. পিয়াস করিম ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ড. মঞ্জুরুল করিম—‘পিয়াস’ ছিল তাঁর ডাক নাম, যা পরবর্তীতে তাঁর স্থায়ী পরিচয় হয়ে ওঠে।
১৯৭৩ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক তত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় ও মিসৌরি কালভার-স্টকটেন কলেজে প্রায় ১৭ বছর শিক্ষকতা করার পর ২০০৭ সালে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, যেখানে তিনি অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করতেন।
নাগরিক সমাজ ও জাতীয় প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য সবসময়ই ছিল সাহসী, যুক্তিনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক। তাঁর চিন্তা, গবেষণা ও প্রজ্ঞা আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।