আফগানিস্তানে নারীদের ওপর নতুন এক ফতোয়া জারি করেছে তালেবান সরকার। এবার তারা নারীদের জন্য পুকুর, খাল বা জলাধারে গোসল ও কাপড় ধোয়ার ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন থেকে গৃহস্থালির কোনো কাজেই জলাশয়ে যেতে পারবেন না নারীরা। এক কথায়—পুকুরে নামা নিষিদ্ধ। চলতি মাসের ৫ অক্টোবর তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা (Hibatullah Akhundzada) এ নির্দেশ জারি করেন বলে জানা গেছে।
দেশটির কান্দাহার প্রদেশে ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে চিহ্নিত খাল, পুকুর ও জলাধারে নারীদের গোসল, কাপড়, কার্পেট এবং গৃহস্থালির অন্যান্য জিনিসপত্র ধোয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্দেশ ভঙ্গ করলে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। খবর দিয়েছে আফগান টাইমস।
সামাজিক বন্ধন ভাঙছে তালেবানের নিষেধাজ্ঞায়
কান্দাহারে পানির স্বল্পতার কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি জলাধারের পানি ব্যবহার করে আসছিলেন। এটি শুধু গৃহস্থালির প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ ছিল না—পুকুরপাড় ছিল তাদের সামাজিক মেলবন্ধনেরও স্থান। সেখানেই তারা কাজের ফাঁকে একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করতেন, তৈরি হতো পারস্পরিক সহায়তা ও সম্প্রীতির বন্ধন। কিন্তু নতুন এই নিষেধাজ্ঞায় সেই মানবিক পরিসরটি তালেবানের কড়াকানুনে থমকে গেছে।
এক স্থানীয় নারী আফগান টাইমসকে বলেন, “আমরা বাইরে গিয়ে খাল ও পুকুরে কাপড় ধুতাম। এটি ছিল অন্যান্য নারীদের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলার একমাত্র সুযোগ। এখন আমাদের ঘরে গোসল করতে বাধ্য করা হচ্ছে—যেখানে পর্যাপ্ত পানি নেই, জায়গাও নেই। এটি আমাদের জীবনের গতি সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত করেছে।”
আরেক নারী জানান, “জলাধারে যাওয়া শুধু কাপড় ধোয়ার ব্যাপার ছিল না, এটি ছিল আমাদের সামাজিক জীবনের অংশ। এখন আমাদের সেই ছোট্ট স্বাধীনতাটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
নাগরিক সমাজের কর্মীরাও তালেবানের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। কান্দাহারভিত্তিক কর্মী মোহাম্মদ ওয়াসিল নায়াব মন্তব্য করেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা মূলত নারীদের জনজীবন থেকে অদৃশ্য করে দেওয়ার আরেকটি প্রচেষ্টা। তার ভাষায়, “এই নীতিগুলো কেবল নারীর স্বাধীনতাকেই সীমাবদ্ধ করছে না, বরং আমাদের সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকেও ধ্বংস করছে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International) বারবার সতর্ক করেছে যে, তালেবানের এমন নীতিমালা নিয়মতান্ত্রিক লিঙ্গ নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ছে। তাদের মতে, এটি শুধু আন্তর্জাতিক আইনই লঙ্ঘন করছে না, বরং ইসলামী নীতিমালারও পরিপন্থী।
আরও একাধিক কঠোর নিষেধাজ্ঞা
তালেবান সরকার এখানেই থামেনি। প্রদেশটিতে আরও এক নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে—নারীদের পোশাক কোনো পুরুষ দর্জি সেলাই করতে পারবেন না। এমনকি গত মাসে গোপনে নারীদের কাপড় সেলাই করার অভিযোগে দশজন দর্জিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই পরিস্থিতি উরুজগান প্রদেশেও দেখা গেছে।
স্বাস্থ্যখাতেও একই চিত্র। সেখানে দাঁতের চিকিৎসার জন্য কোনো নারী দন্তচিকিৎসক নেই। তালেবানের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিবারগুলো নারীদের পুরুষ ডেন্টিস্টের কাছে পাঠাতে রাজি নয়, ফলে অসংখ্য নারী মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
উরুজগান জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান ডা. মোহাম্মদুল্লাহ রোহানি বলেন, “পুরো প্রদেশে একজনও মহিলা দন্তচিকিৎসক নেই। যেসব নারীর দাঁতের যত্ন প্রয়োজন, তারা বাধ্য হয়ে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে চাইলেও অনেকের জন্য সেই সুযোগও নেই।”